অসুখী একজন (কবিতা) পাবলো নেরুদা – মাধ্যমিক দশম শ্রেণীর বাংলা প্রশ্ন ও উত্তর |
(১) বহু বিকল্প ভিত্তিক প্রশ্নগুলির উত্তর দাও :
১.১ “আমি তাকে ছেড়ে দিলাম” – তাকে কোথায় ছেড়ে দিয়েছিলেন?
(ক) অপেক্ষায় দাঁড় করিয়ে রেখে জানালায়
(খ) অপেক্ষায় বসিয়ে রেখে দরজায়
(গ) অপেক্ষায় দাঁড় করিয়ে রেখে বেলকানিতে
(ঘ) অপেক্ষায় দাঁড় করিয়ে রেখে দরজায়
উত্তর : (ঘ) অপেক্ষায় দাঁড় করিয়ে রেখে দরজায়
১.২ কবি পাবলো নেরুদার জন্মস্থান ছিল –
(ক) আমেরিকা
(খ) চিলি
(গ) মেক্সিকো
(ঘ) জার্মানি
উত্তর (খ) চিলি
১.৩ “সে জানতো না আমি আর কখনো ফিরে আসবো না”। – এখানে ‘সে’ হল –
(ক) একটি লোক
(খ) একটি যুবক
(গ) একজন মা
(ঘ) একটি মেয়ে
উত্তর : (ঘ) একটি মেয়ে
১.৪ পাবলো নেরুদার প্রকৃত নাম হল –
(ক) নেফতালি রিকার্দো রেইয়েস বাসোয়ালতো
(খ) জান নেরুদা
(গ) রেয়েন্স রিকার্দো নেফতালি বাসোয়ালতো
(ঘ) পল ভারলেইন
উত্তর : (ক) নেফতালি রিকার্দো রেইয়েস বাসোয়ালতো
১.৫ “বৃষ্টিতে ধুয়ে দিল আমার পায়ের দাগ” – বৃষ্টি কখন বক্তার পায়ের দাগ ধুয়ে দিল?
(ক) বক্তার মৃত্যুকালে
(খ) শরৎকালের
(গ) বর্ষাকালে
(ঘ) বক্তার গৃহত্যাগের এক বছর পর
উত্তর : (ঘ) বক্তার গৃহত্যাগের এক বছর পর
১.৬ “তারপর যুদ্ধ এলো” –
(ক) পাহাড়ের আগুনের মত
(খ) রক্তের এক আগ্নেয় পাহাড়ের মত
(গ) দাবানলের মত
(ঘ) রক্তের সমুদ্রের মতো
উত্তর : (খ) রক্তের এক আগ্নেয় পাহাড়ের মত
১.৭ “সেই মেয়েটির মৃত্যু হল না”। – এখানে কোন মেয়েটির কথা বলা হয়েছে?
(ক) কথকের স্ত্রী
(খ) কথকের মা
(গ) কথকের জন্য অপেক্ষারত মেয়েটি
(ঘ) কথকের মেয়ে
উত্তর : (গ) কথকের জন্য অপেক্ষারত মেয়েটি
১.৮ “শিশু আর বাড়িরা খুন হলো”। – এদের খুন হওয়ার কারণ –
(ক) বাড়িতে ডাকাত পড়েছিল
(খ) দাঙ্গায়
(গ) মন্বন্তরে
(ঘ) যুদ্ধে
উত্তর : (ঘ) যুদ্ধে
১.৯ “যারা হাজার বছর ধরে ডুবেছিল ধ্যানে”। – কারা হাজার বছর ধ্যানে ডুবেছিল?
(ক) শান্ত দেবদেবীরা
(খ) শান্ত হলুদ দেবতারা
(গ) সন্ন্যাসীরা
(ঘ) মহাপুরুষেরা
উত্তর : (খ) শান্তহলুদ দেবতারা
১.১০ “রক্তের একটা কালো দাগ”। – দাগটা কালো কেন?
(ক) রক্তপাতের পর বহু সময় অতিক্রান্ত
(খ) রক্তের সঙ্গে রং মেশানো
(গ) রক্ত শুকিয়ে গেছে তাই
(ঘ) রক্তের রং কালো ছিল
উত্তর : (ক) রক্তপাতের পর বহু সময় অতিক্রান্ত
(২) অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্নগুলির উত্তর দাও :
২.১ পাবলো নেরুদা কত খ্রিস্টাব্দে এবং কোন বিষয়ে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন?
উত্তর : ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে, সাহিত্যে।
২.২ “আমি তাকে ছেড়ে দিলাম”। – বক্তা কাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন?
উত্তর : বক্তা তার প্রিয়তমাকে ছেড়ে দিয়েছিলেন।
২.৩ “একটা কুকুর চলে গেল, হেঁটে গেল গির্জার এক নান” – কোন সময়ের কথা এখানে বলা হয়েছে?
উত্তর : যুদ্ধ পূর্ববর্তী কালে বক্তার গৃহ ত্যাগের সময়।
২.৪ “তারপর যুদ্ধ এল” – এখানে কোন্ যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে?
উত্তর : স্পেনের গৃহযুদ্ধের কথা বলা হয়েছে।
২.৫ “সমস্ত সমতলে ধরে গেল আগুন” – আগুন ধরার কারন কি?
উত্তর : স্পেনে যুদ্ধকালীন সময়ে যুদ্ধের তাণ্ডবে সমস্ত সমতলে আগুন ধরে গিয়েছিল।
২.৬ “উল্টে ড়লো মন্দির থেকে” – এখানে কাদের উল্টে পড়ার কথা বলা হয়েছে?
উত্তর : হাজার বছর ধরে ধ্যানেমগ্ন শান্ত হলুদ দেবতাদের কথা বলা হয়েছে।
২.৭ “সেখানে ছড়িয়ে রইল কাঠ-কয়লা” – কোথায় কাঠ-কয়লা ছড়িয়ে ছিল?
উত্তর : যেখানে আগে বড় শহর ছিল যুদ্ধের পর সেখানে কাঠ কয়লা ছড়িয়ে রইল।
(৩) ব্যাখ্যা ভিত্তিক প্রশ্নগুলির সংক্ষিপ্ত উত্তর দাও :
প্রশ্নঃ ‘সেই মেয়েটির মৃত্যু হলো না।’ – কোন মেয়েটির কেন মৃত্যু হল না?
উত্তরঃ পাবলো নেরুদার ‘অসুখী একজন’ কবিতার কথকের জন্য অপেক্ষারতা যে মেয়েটির উল্লেখ পাওয়া যায়, তার কথা বলা হয়েছে। মেয়েটির পরিচয় মেয়েটি জানত না যে, তার প্রিয়তম আর ফিরে আসবে না। জীবন আপন ছন্দে চলল, ক্রমে সপ্তাহ – বছর অতিক্রান্ত হল। কবির পদচিহ্ন বৃষ্টিতে ধুয়ে গেল, তবু অপেক্ষা চলল। এরপর যুদ্ধের গ্রাসে নগর, দেবালয় চূর্ণবিচূর্ণ হল এবং মৃত্যু হল শিশুসহ অজস্র মানুষের। শুধু অপেক্ষমান মেয়েটির মৃত্যু হল না কারণ ভালোবাসা অমর, চিরন্তন ও শাশ্বত।
প্রশ্নঃ ‘সেখানে ছড়িয়ে রইল কাঠকয়লা’ – বলতে কবি প্রশ্নোদৃত অংশে কবি কী বুঝিয়েছেন?
উত্তরঃ পাবলো নেরুদার ‘অসুখী একজন’ কবিতাটিতে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে কবি প্রিয়তমা, ঘরবাড়ি, এমনকি তাঁর প্রিয় শহরও ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। এরপরে একদিন আসে বীভৎস যুদ্ধ। যার করাল গ্রাসে কবির ঘরবাড়ি, দেবালয় সমস্ত কিছু চূর্ণ হয়ে আগুনে জ্বলে যায়, শহরটিও বাদ যায় না। এক সময়ের সুন্দর শহরে ছড়িয়ে থাকে কাঠকয়লা, দোমড়ানো লোহা, মৃত পাথরের মূর্তির বীভৎস মাথা আর রক্তের দাগ। আসলে শহরের বিধ্বংসী রূপটি তুলে ধরতেই উদ্ধৃতিটি ব্যবহৃত হয়েছে।
প্রশ্নঃ ‘কমন উল্টে পড়ল মন্দির থেকে টুকরো টুকরো হয়ে’ – মন্দির থেকে কী উলটে পড়ল? কী কারণে উলটে পড়েছিল ?
উত্তরঃ পাবলো নেরুদার ‘অসুখী একজন’ কবিতা অনুসারে মন্দির থেকে শান্ত হলুদ দেবতারা উলটে পড়েছিল।
আগ্নেয়পাহাড়ের মতো ভয়াবহ যুদ্ধ সমতলে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেই যুদ্ধের লেলিহান শিখায় ধ্বংস হয়েছিল মন্দির ও বিগ্রহ। কবির ভাষায় ‘শান্ত হলুদ’ দেবতাদের দেবালয় টুকরো টুকরো হয়ে উলটে পড়ে। অর্থাৎ যুদ্ধের রক্তক্ষয়ী স্পর্শে মানুষের অন্তরমনের হাজার বছরের জীর্ণ বিশ্বাস টাল খায়। যুদ্ধ যেন দেবত্বের ধ্যানস্থ–নিষ্ক্রিয় অবস্থাকেও ভেঙে চুরমার করে।
প্রশ্নঃ ‘বৃষ্টিতে ধুয়ে দিল আমার পায়ের দাগ/ঘাস জন্মালো রাস্তায়’ – উদ্ধৃতাংশটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করো।
উত্তরঃ উদ্ধৃতাংশের তাৎপর্য উত্তর উদ্ধৃতিটি পাবলো নেরুদার ‘অসুখী একজন’ কবিতা থেকে গৃহীত। কথক তাঁর প্রিয়তমাকে অপেক্ষমান রেখে জীবন ও জীবিকার তাগিদে বহুদুরে পাড়ি দেন। থমকে যায় মেয়েটির জীবন কিন্তু সময় থেমে থাকে না। তাই কথকের চলে যাওয়াতে জীবনের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয় না। সপ্তাহ – বছর কেটে যায় । প্রাকৃতিক নিয়মেই কথকের চলার পথের পদচিহ্ন মুছে যায়। তাতে ঘাস জন্মায়। কিন্তু কবির চলে যাওয়ার মুহূর্তটি তার প্রিয়তমার হৃদয়ে অন্তহীন অপেক্ষার মুহূর্ত হয়ে রয়ে যায়।
প্রশ্নঃ ‘আমি তাকে ছেড়ে দিলাম’ – কবি কাকে ছেড়ে দিলেন? তাকে তিনি কীভাবে রেখে এসেছিলেন?
উত্তরঃ পাবলো নেরুদার ‘অসুখী একজন’ কবিতা থেকে গৃহীত অংশে কথক তাঁর প্রিয় নারীকে অপেক্ষায় রেখে নিজ বাসভূমি ছেড়ে দূরে চলে গিয়েছিলেন।
স্বদেশ ছেড়ে দূর থেকে দূরতর কোনো স্থানে চলে যাওয়ার সময় তিনি দরজায় তাঁর অপেক্ষায় দাঁড় করিয়ে রেখে যান কোনো এক প্রিয়জনকে। যদিও সে জানত না যে , কবি আর কখনও ফিরে আসবে না। এইভাবেই কবি এক চিরকালীন বিদায় মুহূর্তের ছবি এঁকেছেন।
প্রশ্নঃ ‘সে জানত না’ – কী জানত না? না জানা বিষয়টি বিশ্লেষণ করো।
উত্তরঃ নেরুদার ‘অসুখী একজন’ কবিতায় অপেক্ষাতুরা মেয়েটির একথা জানা ছিল না যে, কবি আর কখনও স্ববাসভূমিতে ফিরে আসবেন না। পাঠ্য কবিতাটি শুরু হয় এক বিদায়দৃশ্যকে অবলম্বন করে। বাড়ির দরজায় প্রিয়তমাকে ফেলে রেখে কবি চলে যান বহুদুরের অজ্ঞাত কোনো স্থানে। এই যাত্রার কারণ কবিতায় উল্লিখিত হয় না। কিন্তু এটা স্পষ্ট হয়ে ফুটে ওঠে তিনি তাঁর ভালোবাসার নারী, প্রিয় না – জানা বিষয়টি ঘরবাড়ি এবং পছন্দের শহরটিকে ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। এই সমস্ত কিছুর সঙ্গে চিরবিচ্ছেদের এ ঘটনা কবিকে পীড়িত ও বিচলিত করে। অথচ মেয়েটি তা বুঝতে পারে না। মেয়েটির জীবনে প্রিয়তমের জন্য অন্তহীয় অপেক্ষার পালা এভাবেই নীরবে নেমে আসে।
প্রশ্নঃ যুদ্ধকে ‘রক্তের এক আগ্নেয়পাহাড়’ বলা হয়েছে কেনো?
উত্তরঃ উদ্ধৃত প্রসঙ্গটি কবি পাবলো নেরুদা রচিত ‘অসুখী একজন’ কবিতা থেকে গৃহীত।
আগ্নেয় পাহাড় কারণ কবিতায় যুদ্ধকে কবি আগ্নেয়পাহাড়ের সঙ্গে তুলনা করেছে। আগ্নেয়পাহাড় চারপাশে ছড়িয়ে দেয় জ্বলন্ত লাভা। আর সেই আগুনে ছাই হয় জীবনের যাবতীয় চিহ্ন। ঠিক তেমনই যুদ্ধের ফলে মানুষের মনে জমে থাকা হিংসা–দ্বেষ আর ঘৃণা লাভার মতো ছিটকে ওঠে। অপমৃত্যু ঘটে মানবতার। এই মৃত্যুময় ধ্বংসলীলার নারকীয় রূপটিকে ফুটিয়ে তুলতেই কবি যুদ্ধকে, ‘রক্তের এক আগ্নেয়পাহাড়’ বলেছেন।
প্রশ্নঃ ‘শান্ত হলুদ দেবতারা’ – দেবতাদের ‘শান্ত হলুদ’ বলা হয়েছে কেন? তাদের কী পরিণতি হয়েছিল?
উত্তরঃ ‘অসুখী একজন’ কবিতায় কবি চলে যাওয়ার পর একসময় যুদ্ধ বাধল। সেই যুদ্ধের বীভৎসতায় নগরসভ্যতা, কবির স্বপ্নের বাড়ি–ঘর সব চূর্ণ হয়ে গেল, এমনকি ধ্বংস হল দেবতাদের মন্দিরও। হাজার হাজার বছরের যে দেবতারা মানুষের মনে বিশ্বাস জাগিয়ে এসেছেন, যুদ্ধ তাদেরও আসনচ্যুত করল। প্রাচীন দেবতাদের নিষ্ক্রিয়তা ও জীর্ণতাকে বোঝাতে হলুদ ও শান্ত বলা হয়েছে। যুদ্ধের আগুনে নগর পুড়লে দেবালয়ও বাদ যায় না। মানুষের মনে দেবতারা যে বিশ্বাস বোধের জন্ম দিয়েছিল, তা পরিণতি ধ্বংস হল।
প্রশ্নঃ ‘তারা আর স্বপ্ন দেখতে পারল না।’ – উদ্ধৃতাংশটির তাৎপর্য বিশ্লেষণ করো।
উত্তরঃ উদ্ধৃত অংশটি পাবলো নেরুদার কবিতা ‘অসুখী একজন’ থেকে গৃহীত।
এখানে কবি বিনাশ ও ধ্বংসের কলরোলে দৈবীমহিমার অসারতার প্রতি কটাক্ষপাত করেছেন। মানবতার অপচয় প্রাণহানি কিংবা চূড়ান্ত বীভৎসতার সময় কোনো দৈব মাহাত্ম্য প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না। উদ্ধৃতাংশের তাৎপর্য মানুষের মতোই একইরকমভাবে যুদ্ধ-তাণ্ডবের ভয়াবহতায় তারাও নিরাশ্রয়, অস্তিত্বহীন এবং চূর্ণবিচূর্ণ হয়। তাই এককথায় দৈব ক্ষমতার ফানুস চুরমার হয়ে যাওয়ায় তাদের যেন মানুষকে স্বপ্ন দেখানোর ক্ষমতা লোপ পায়। আলোচ্য অংশে কবির এই ভাবনাই প্রকাশ পেয়েছে।
প্রশ্নঃ ‘আর সেই মেয়েটি আমার অপেক্ষায়।’ – মেয়েটি কে? সে অপেক্ষা করে কেন?
উত্তরঃ পাবলো নেরুদার ‘অসুখী একজন’ কবিতায় ‘সেই মেয়েটি’ হল কথকের প্রিয়তমা, যাকে রেখে কবি বহুদূরে চলে গিয়েছিলেন। কবি যে আর ফিরে আসবেন না এ কথা তার প্রিয়তমা জানত না। তার অপেক্ষার বোঝা গভীর থেকে গভীরতর হলেও সে ভেঙে পড়েনি। এই মেয়েটিকে ধ্বংস যেন স্পর্শ করতে পারে না; মৃত্যু – যুদ্ধ – হিংসা, দাঙ্গার স্পর্শ পেরিয়েও তাই সে অমলিন থাকে। কারণ ভালোবাসার কখনও মৃত্যু হয় না। সেসময় থেকে সময়ান্তরে অপেক্ষা করে বয়ে চলে নিজস্ব ধারায়।
(৪) রচনাধর্মী প্রশ্নগুলির উত্তর দাও :
প্রশ্নঃ ‘তারপর যুদ্ধ এল’ — পাঠ্য কবিতায় কবি যুদ্ধের যে আশ্চর্য করুণ ও মর্মস্পর্শী ছবি এঁকেছেন, তা নিজের ভাষায় আলোচনা করো।
উত্তরঃ চিলিয়ান কবি পাবলো নেরুদা জীবনযুদ্ধের একজন লড়াকু সৈনিক। চোখের সামনে ঘটে যাওয়া দুই বিশ্বযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি। তাই পাঠ্য কবিতায় তিনি যুদ্ধের যে করুণ ও মর্মস্পর্শী ছবি এঁকেছেন তা অত্যন্ত বাস্তবোচিত। ‘অসুখী একজন’ কবিতাটি আসলে যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে এক শাশ্বত ভালোবাসার গল্প। কবি যুদ্ধের বীভৎসতার মাঝে প্রেম যে অনির্বাণ তা দেখাতে গিয়ে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধের চিত্র তুলে ধরেছেন। কবি তাঁর প্রিয়তমাকে অপেক্ষায় রেখে দূরে চলে যাওয়ার পর একদিন ভয়াবহ বীভৎসতা নিয়ে যুদ্ধ নেমে এল। মানুষ আশ্রয়হীন হল। নৃশংসতার হাত থেকে রেহাই পেল না শিশুরাও। দাবানলের মতো যুদ্ধের আগুন সমতলে ছড়িয়ে পড়ল। ধ্বংস হল দেবালয় আর তার ভেতরের দেবতারা। তাদের দেবত্ব নষ্ট হল। মানুষকে তারা স্বপ্ন দেখাতে ব্যর্থ হল। কবির সেই মিষ্টি বাড়ির ঝুলন্ত বিছানা, গোলাপি গাছ, প্রাচীন জলতরঙ্গ সব চূর্ণ ও ভস্ম হল যুদ্ধের আগুনে। ঠিক একইভাবে শহরটাও পুড়ে গেল। বীভৎসতার চিহ্ন নিয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রইল কাঠকয়লা, দোমড়ানো লোহা, পাথরের মূর্তির বীভৎস মাথা আর রক্তের একটা কালো দাগ। শুধু সেই ধ্বংসস্তূপে বেঁচে থাকল মেয়েটির অপেক্ষা ও অবিচল ভালোবাসা।
প্রশ্নঃ ‘অসুখী একজন’ — কবিতায় কাকে ‘অসুখী’ বলা হয়েছে? তার অসুখী হওয়ার নেপথ্যে কোন্ কারণ রয়েছে?
উত্তরঃ পাবলো নেরুদার ‘অসুখী একজন’ কবিতায় প্রিয়তমের জন্য অপেক্ষারতা মেয়েটিকে অসুখী বলা হয়েছে। আবার ফিরে আসতে উৎসুক কবি–হৃদয়ও এক্ষেত্রে একইভাবে অসুখী।
একদিন কবি স্বদেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। তাঁর এই নিষ্ক্রমণ চিরদিনের জন্য। অথচ অপেক্ষমান প্রিয়তমার এ সত্য জানা নেই। যদিও জীবন নিজস্ব ছন্দে বয়ে চলে। দৈনন্দিনতার গতি কবির স্মৃতিকে ক্রমশ ফিকে অসুখী হওয়ার কারণ করে তোলে, বছর গড়ায়। কিন্তু ভালোবাসার মেয়েটির কাছে এই অন্তহীন অপেক্ষা গভীর ও ভারী পাথরের আঘাতের মতোই শ্বাসরুদ্ধকারী হয়ে ওঠে। এরপর যুদ্ধের বীভৎসতা সমস্ত সমতলকে গ্রাস করে। ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয় দেবতা ও দেবালয়। ধ্বংসের লেলিহান আগুনে ক্রমে জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যায়। কবির প্রিয় বাড়ি, বারান্দার ঝুলন্ত বিছানা, গোলাপি গাছ, করতলের মতো পাতা চিমনি, প্রাচীন জলতরঙ্গ এই সব কিছু। মানুষ তার আশ্রয় হারায়। যুদ্ধের নৃশংসতায় শিশুরাও খুন হয়। শহরের বদলে সেখানে ছড়িয়ে থাকে কাঠকয়লা, দোমড়ানো লোহা, পাথরের মূর্তির বীভৎস মাথা আর রক্তের কালো দাগ। শুধু অপেক্ষারতা সেই মেয়েটিকে কোনো বিনাশ স্পর্শ করতে পারে না। সমূহ ধ্বংস আর বর্বরতার মধ্যেও অসুখী মেয়েটি তার ভালোবাসার আর্তি ও আকুতিকে অনির্বাণ দীপশিখার মতো জ্বালিয়ে রাখে।
প্রশ্নঃ ‘যেখানে ছিল শহর’ – ‘যেখানে’ শব্দটি প্রয়োগ করার কারণ কী? শহরটির কী হয়েছিল?
উত্তরঃ উদ্ধৃতিটি পাবলো নেরুদার ‘ অসুখী একজন ’ কবিতার অংশ । কথক বা কবির বাসভূমি যে শহরে, এক্ষেত্রে সেখানকার কথা বলা হয়েছে। এই শহরটি কবি বা কথকের কাছে স্মৃতিবিজড়িত, কারণ এখানেই তিনি তার প্রিয় নারীটিকে অপেক্ষমান রেখে বহুদুরে পাড়ি দিয়েছিলেন। কবির এই বাসভূমি, প্রিয় মুখের সান্নিধ্যে, প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে, স্নিগ্ধতায় ও লাবণ্যে পরিপূর্ণ ছিল। তখনও যুদ্ধের আঘাত এই শহরকে স্পর্শ করতে পারেনি বোঝাতেই কবি ‘যেখানে’ শব্দটি প্রয়োগ করেছেন।
যুদ্ধের ভয়ংকর নিষ্ঠুরতায় কবির শহর ধ্বংসের মুখোমুখি গিয়ে দাঁড়ায়। যুদ্ধের আঘাতে সমস্ত সমতলজুড়ে আগুন লাগল। দেবালয়ও তার হাত থেকে রক্ষা পেল না। মানুষের মধ্যেকার যে দেবত্বের যুদ্ধ পরবর্তী মিথ ছিল তা ধ্বংস হয়ে গেল। সেইসঙ্গে নিশ্চিহ্ন হল কবির মধুর স্মৃতিবিজড়িত সেই স্বপ্নের বাড়িটিও। কবির বারান্দায় যেখানে ঝুলন্ত বিছানায় তিনি ঘুমিয়েছিলেন, তার প্রিয় গোলাপি গাছ, ছড়ানো করতলের মতো পাতা চিমনি ও প্রিয় জলতরঙ্গ সবই ধ্বংস হল যুদ্ধের আগুনে। গোটা শহরটাই পুড়ে গেল । সেখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে রইল কাঠকয়লা, দোমড়ানো লোহা, মৃত পাথরের বীভৎস মাথা ও রক্তের একটা কালো দাগ। কবির প্রিয় শহরের প্রতিচ্ছবি, যুদ্ধের বীভৎসতা মানুষের লোভ, হিংসা এবং বর্বরতাকে স্পষ্ট করে তুলেছে, যা পাঠককে স্তম্ভিত করেছে।
প্রশ্নঃ ‘শিশু আর বাড়িরা খুন হলো।’ – ‘শিশু আর বাড়িরা’ কীভাবে খুন হল? ‘খুন’ শব্দটি ব্যবহারের সার্থকতা বিচার করো।
উত্তরঃ আলোচ্য পঙ্ক্তিটি পাবলো নেরুদার লেখা ‘অসুখী একজন’ কবিতাটি থেকে গৃহীত। ভয়াবহ এক যুদ্ধে কথকের শহরের শিশু আর গৃহস্থ মানুষেরা খুন হল। কবিতায় ‘বাড়িরা’ বলতে বাড়ির মানুষদের বোঝানো হয়েছে।
খুন শব্দ ব্যবহারের সার্থকতা কথক তাঁর প্রিয়তমাকে অপেক্ষায় রেখে দূরে চলে যাওয়ার পর বছর কেটে গেল। একসময় শুরু হল ভয়ানক যুদ্ধ। যুদ্ধের আগুনে পুড়ে ছারখার হয়ে গেল কথকের প্রিয় শহর। ভেঙে পড়ল মন্দির আর মন্দিরের ভেতরের দেবমূর্তি। এমনকি সেই যুদ্ধের হিংস্রতা থেকে রক্ষা পেল না নিরপরাধ শিশুরাও। শহরের বাড়িগুলোও ধ্বংস হল একে একে। এখানে কবি ‘বাড়িরা’ শব্দটি প্রয়োগের মাধ্যমে ঘরবাড়ির মতো জড়পদার্থেও প্রাণের সঞ্চার করেছেন। শিশুদের মতো বাড়িও যে মানুষের পরম আদরের, মমতার সেটা বোঝাতেই কবি ‘বাড়িরা’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। যুদ্ধজনিত কারণে মৃত্যুকে সাধারণভাবে ‘খুন’ বলা হয় না। কিন্তু এখানে কবি ইচ্ছাকৃত ভাবেই ‘খুন’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। কিছু যুদ্ধবাজ মানুষ স্বার্থসিদ্ধির উদ্দেশ্যে যুদ্ধ বাধায়। কিন্তু তার মাশুল গুনতে হয় দেশের অগণিত সাধারণ মানুষকে। সেই ভয়ানক ধ্বংসলীলায় মানুষ হারায় তার পরিবার, প্রিয়জন, এমনকি শেষ আশ্রয়টুকুও। যুদ্ধের এই ভয়ংকর পরিণতিকে ফুটিয়ে তুলতে কবি এই কবিতায় ‘খুন’ শব্দটি যথাযথভাবে ব্যবহার করেছেন।
প্রশ্নঃ অপেক্ষারত প্রিয়জনের কাছে ফিরতে না পারার যে বেদনা ‘অসুখী একজন’ কবিতায় ব্যক্ত হয়েছে আলোচনা করো।
উত্তরঃ কবি পাবলো নেরুদার ‘অসুখী একজন’ কবিতায় মানবমনের এক চিরন্তন সত্য প্রকাশ পেয়েছে। কবি যেন কোনো এক নারীকে তাঁরই অপেক্ষায় দাঁড় করিয়ে দূরে চলে যান। সেই অপেক্ষারতা যদিও জানত না যে, কবি আর কখনও ফিরবেন না।
কবিতার আরম্ভের বিচ্ছেদদৃশ্যে লুকিয়ে থাকে দুজন নরনারীর চিরকালীন প্রত্যাশা ও অপেক্ষার বীজ। যদিও জীবন তার উদ্ধৃতাংশের তাৎপর্য নিজের গতিতে চলতে থাকে। টুকরো টুকরো প্রাত্যহিকতায় সপ্তাহ আর বছর কেটে যায়। বৃষ্টিতে কবির পদচিহ্ন ধুয়ে, ‘ঘাস জন্মালো রাস্তায়’। কবির অস্তিত্ব অনেকের মন থেকেই একটু একুট করে মুছে যেতে থাকে। কিন্তু পাথরের মতো ভারী, গভীর ও দীর্ঘস্থায়ী যন্ত্রণায় সেই অপেক্ষারতা নারীর দিন কাটে। এরপর আসে যুদ্ধ। সমতলে আগুন ধরায়। ধ্বংস হয় মানুষের স্বপ্নের আশ্রয়। রক্ষা পায় না শিশুরাও। এতদিনকার রক্ষণশীলতার প্রতীক মন্দির আর মন্দিরের দেবমূর্তিগুলো ধূলিসাৎ হয়। কবির মিষ্টি বাড়িটিও ধ্বংস হয়। যুদ্ধের আগুনে ভস্মীভূত হয় সমস্ত শহর। যত্রতত্র ছড়িয়ে থাকে কাঠকয়লা, দোমড়ানো লোহা, মৃত পাথরের মূর্তির বীভৎস মাথা ও রক্তের শুকনো কালো দাগ। শুধু এই যুদ্ধের বীভৎসতা ছুঁতে পারে না কবির সেই প্রিয় অপেক্ষারতার ভালোবাসাকে। ধ্বংস ও বিনাশের হাজার লেলিহান শিখা তাকে কোনোমতেই ধ্বংস করতে পারে না। সময়ান্তরে প্রবহমান মানবহৃদয়ের যন্ত্রণা, আকুতি ও আর্তিই সেই মেয়েটির মধ্য দিয়ে ফুটে ওঠে, অনুভূতির অবিনাশী প্রকাশ হিসেবে।