“আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি”কবিতার আরো প্রশ্নোত্তর-PART-3

“আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি”

(১) বহু বিকল্প ভিত্তিক প্রশ্নগুলির উত্তর দাও :

১.১ “আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি” কবিতাটি কোন কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত?

(ক) “জলই পাষাণ হয়ে গেছে”

(খ) “দিনগুলি রাতগুলি”

(গ) “বাবরের প্রার্থনা”

(ঘ) “তুমি তো তেমন গৌরী নও”

উত্তর : (ক) “জলই পাষাণ হয়ে গেছে”

১.২ আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি কবিতাটি কি ধরনের কবিতা?

(ক) মহাকাব্যিক

(খ) রোমান্টিক

(গ) তন্ময়ধর্মী

(ঘ) মন্ময়ধর্মী

উত্তর : (গ) তন্ময়ধর্মী

১.৩ “আমাদের ডান পাশে _________” – শূন্যস্থান পূরণ করো।

(ক) গিরিখাদ

(খ) গহ্বর

(গ) গর্ত

(ঘ) ধ্বস

উত্তর : (ঘ) ধ্বস

১.৪ আমাদের “পায়ে পায়ে” কি রয়েছে?

(ক) বাধা

(খ) বিপদ

(গ) হিমানীর বাঁধ

(ঘ) সংকট

উত্তর : (গ) হিমানীর বাঁধ

১.৫ “আমাদের ঘর গেছে উড়ে” – লাইনটির অর্থ হলো –

(ক) আগুন লেগে আমাদের ঘর পুড়ে গিয়েছে

(খ) বোমার আঘাতে আমাদের ঘর উড়ে গিয়েছে

(গ) আমরা আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছি

(ঘ) ঝড়ে আমাদের ঘর উড়ে গিয়েছে

উত্তর : (গ) আমরা আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছি

১.৬ “ছড়ানো রয়েছে কাছে দূরে”। – কাছে দূরে কি ছড়ানো রয়েছে?

(ক) শিশুদের শব

(খ) ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘরবাড়ি

(গ) হিমানীর বাঁধ

(ঘ) দেবতাদের শব

উত্তর : (ক) শিশুদের শব

১.৭ “এই মুহূর্তে মরে যাব না কি”? – বক্তা কি দেখে একথা বলেছেন?

(ক) বক্তা যখন সমুদ্রস্নানে মত্ত

(খ) বক্তা নিজেদের শিশুদেরকে শবে পরিণত হতে দেখেছেন

(গ) বক্তা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে যখন পড়েছিলেন

(ঘ) বক্তা যখন বিমানে উপবিষ্ট ছিলেন

উত্তর : (খ) বক্তা নিজেদের শিশুদেরকে শবে পরিণত হতে দেখেছেন

১.৮ “আমরা ভিখারি _________”। – শূন্যস্থান পূরণ করো –

(ক) ছয় মাস

(খ) আট মাস

(গ) দশ মাস

(ঘ) বারো মাস

উত্তর : (ঘ) বারো মাস

১.৯ “পৃথিবী হয়তো গেছে মরে” – বক্তার এরকম বলার কারণ কি?

(ক) পৃথিবী উষ্ণতায় পূর্ণ

(খ) পৃথিবীর আয়ু আর নেই

(গ) মানুষের মনুষ্যত্ব হীনতা

(ঘ) পৃথিবী দূষণময়

উত্তর : (গ) মানুষের মনুষ্যত্ব হীনতা

১.১০ “আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি” – কবি কিভাবে বেঁচে থাকতে চেয়েছেন?

(ক) কাঁধে কাঁধ রেখে

(খ) হাতে হাত রেখে

(গ) দুই হাতে দড়ি বেঁধে রেখে

(ঘ) দুই পায়ে দড়ি বেঁধে রেখে

উত্তর : (খ) হাতে হাত রেখে

(২) অতি সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন গুলোর উত্তর দাও :

২.১ “পায়ে পায়ে হিমানীর বাঁধ” – ‘পায়ে পায়ে’ বলতে কবিতায় কী বোঝানো হয়েছে?

উত্তর : ‘পায়ে পায়ে’ বলতে কবি প্রত্যেক পদক্ষেপকে বুঝিয়েছেন।

২.২ “আমাদের পথ নেই কোনো” – কবির এরকম মনে হওয়ার কারণ কি?

উত্তর : বর্তমান এই দুনিয়াতে অসহায় ও নিরুপায় কিছু মানুষ প্রতিকূল অবস্থায় পড়ে দিশেহারা, যাদের কোনো পথ নেই।

২.৩ “আমাদের শিশুদের শব/ ছড়ানো রয়েছে কাছে দূরে” – এ কথা বলার অর্থ কি?

উত্তর : সমকালীন পরিস্থিতি যুদ্ধ, দাঙ্গা, রাজনৈতিক সন্ত্রাসের শিশুহত্যা ঘটেছিল।

২.৪ “আমাদের ইতিহাস নেই” – কবির একথা বলার কারণ কি?

উত্তর : সাধারণ মানুষের কথা কোনদিন ইতিহাসে স্থান পায় না, তারা বিশ্বের ইতিহাসে উপেক্ষিত ও অবহেলিত, তাই তাদের কোনো ইতিহাস নেই।

২.৫ “আমরা ভিখারি বারো মাস” – একথা কেন বলা হয়েছে?

উত্তর : প্রাত্যহিক ভিক্ষাবৃত্তি যেন শোষিত, পিরিত, বঞ্চনায়, সাধারণ মানুষের জীবিকা সংস্থানের একমাত্র উপায়।

২.৬ “পৃথিবী হয়তো বেঁচে আছে/ পৃথিবী হয়তো গেছে মরে” – কবির এরকম বলার কারণ কি?

উত্তর : সমাজের শোষিত, বঞ্চিত, নিপীড়িত ও সাধারণ মানুষ এতোটাই সমাজবিচ্ছিন্ন যে ,পৃথিবী বেঁচে থাকা কিংবা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।

২.৭ “আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি” – কবিতার মূল কথা কি?

উত্তর : সংঘবদ্ধভাবে সমস্যার সম্মুখীন হয়ে তার সমাধান করতে হবে।

(৩) ব্যাখ্যা ভিত্তিক প্রশ্নগুলোর উত্তর দাও :

প্রশ্নঃ ‘আমাদের শিশুদের শব/ছড়ানো রয়েছে কাছে দূরে।’ – উদ্ধতাংশটির তাৎপর্য লেখো। 
উত্তরঃ উদ্ধৃতিটি কবি শঙ্খ ঘোষের ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতার অংশ বিশেষ। যুদ্ধবিধ্বস্ত বর্তমান বিশ্বে আমাদের চারপাশ আজ উদ্ধৃতাংশের তাৎপর্য বিপৎসংকুল। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন; শাসকের মদতপুষ্ট স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীর রক্তক্ষয়ী হানাহানি থেকে শিশুরাও বাদ যায়নি। ‘কাছে দুরে’ গোটা পৃথিবীজুড়েই এখন সদ্যোজাতরাও হিংসাশ্রয়ী যুদ্ধ ও সন্ত্রাসের বলি। কবির আক্ষেপ আমরা এমন এক পৃথিবীতে বাস করি যেখানে শিশুদেরও কোনো নিরাপত্তা নেই। আমরা আমাদের ভবিষ্যৎকে সুরক্ষা দিতে অক্ষম। এই অক্ষমতা মানবতার পক্ষেও গভীর অবমাননার, তাই অত্যন্ত বেদনার।
প্রশ্নঃ ‘আমরা ভিখারি বারোমাস’ – বলতে কবি কী অন্তর্নিহিত অর্থ বুঝিয়েছেন?
উত্তরঃ উদ্ধৃতিটি শঙ্খ ঘোষের ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতার অংশ বিশেষ। আমরা ভিখারি বারোমাস বলতে কবি মানুষের মানসিক দৈন্যের কথা বলেছেন। কবির মতে নানান প্রতিকূলতা ও যুগযন্ত্রণার ক্ষত নিয়ে মানুষ বেঁচে আছে। সে পথহারা, তার মানসিক দৃঢ়তা শিথিল হয়ে পড়েছে। তার প্রকৃত ইতিহাসের সঠিক প্রতিফলন হয়নি জেনেও সে নিশ্চুপ ও বহির্বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন। এভাবে আপাতদুর্বল ও ভীরু সাধারণ মানুষের অবহেলিত মানসিক দৈন্যের কথা বলতে গিয়ে কবি এমন মন্তব্য করেছেন।
প্রশ্নঃ ‘তবু তো কজন আছি বাকি’ – কবি এই উক্তিটির সাহায্যে কী বোঝাতে চেয়েছেন?
উত্তরঃ কবি শঙ্খ ঘোষের ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় উদ্ধৃত উক্তিটি যেন ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বাণী’। কবির মতে, সাম্রাজ্যবাদী ও স্বার্থান্বেষী একদল মানুষ নানান প্রতিকূলতা সৃষ্টি করে সাধারণ মানুষের চলার পথ রুদ্ধ করে দিতে চাইছে। সামাজিক, উদ্ভিটির মূল অর্থ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে তারা নানানভাবে বিপন্ন। তাদের অতীত অস্পষ্ট, অসম্পূর্ণতায় অন্ধকার। আর বর্তমান এবং ভবিষ্যৎও সাম্রাজ্যবাদী শাসকের চক্রান্তে দুর্বিষহ। এরকম প্রতিকূল অবস্থার মাঝে বিবেকবান যে কয়েকজনের অস্তিত্ব আছে, কবি তাদের নিয়ে প্রতিরোধের আশায় এমন উক্তি করেছেন।
প্রশ্নঃ ‘আমাদের পথ নেই কোনো’ – ‘পথ’ বলতে কবি কী বুঝিয়েছেন? কবির এমন আশঙ্কার কারণ ব্যাখ্যা করো।
উত্তরঃ উদ্ধৃতিটি শঙ্খ ঘোষের ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতার ‘পথ’–এর মূল অর্থ অংশ। এখানে ‘পথ’ বলতে এই অবক্ষয়ের যুগে আদর্শহীনতা ও অনিশ্চয়তার অন্ধকার থেকে বেরিয়ে নতুনভাবে বাঁচার উপায় বা দিশাকে বোঝানো হয়েছে। আশঙ্কার কারণ বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ, দাঙ্গা, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা মানুষকে দিশেহারা করে তুলেছে। মানুষ আজ সন্ত্রাস আর বঞ্চনার শিকার। জীবনধারণের প্রতি পদে প্রতিবন্ধকতা তার অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তুলেছে। তাই কবির আশঙ্কা এই অন্ধকারের আবর্ত থেকে বেরিয়ে এসে, মানুষের সুষ্ঠু জীবনযাপনের আর বুঝি কোনো উপায় নেই।
প্রশ্নঃ ‘আয় আরো হাতে হাত রেখে’ – ‘হাতে হাত রাখা’ বলতে কী বোঝায়? এক্ষেত্রে ‘আরো’ শব্দটির প্রয়োগের তাৎপর্য লেখো।
উত্তরঃ শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় হাতে হাত রাখা বলতে মানুষের সংঘবদ্ধতাকে বুঝিয়েছেন।
      ‘আরো’–এর তাৎপর্য হল বিচ্ছিন্নতা, আগ্রাসন, হিংসা, অসহিহ্রুতার বিরুদ্ধে কবি সাহিত্যিকদের লড়াই চিরকালের। তারা চায় শাস্তি, যা সমাজের বৃহত্তর অংশের চাওয়া। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও অশুভ শক্তির প্রভাবে সাধারণ মানুষ আজ বিপন্ন। তবু এত প্রতিকূলতার মাঝেও তাদের মধ্যে যতটুকু প্রতিরোধের ক্ষমতা আছে সেটুকু একত্রিত করার জন্য কবি ‘আরো’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন।
প্রশ্নঃ ‘পৃথিবী হয়তো গেছে মরে’ – এমন সংশয়ের কারণ কী? সংশয়ের কারণ কী?
উত্তরঃ কবি শঙ্খ ঘোষ তাঁর ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় এমন সংশয়পূর্ণ উক্তিটি করেছেন। উপনিষদের কথার রেশ টেনে বলা যায় মানুষ তার মানবতার পক্ষে চলমান, তাই জীবনে থেমে থাকা মৃত্যুরই সমান। আজকের যুদ্ধ ও দাঙ্গাবিধ্বস্ত পৃথিবীতে মানুষ দিশেহারা, তার হাত–পা বাঁধা। গৃহহীন, ইতিহাস বিস্মৃত এই নিরন্ন মানুষগুলি নিজের ভাবী প্রজন্মকে রক্ষা করতে ব্যর্থ। জীবনের অর্থহীনতায় বেঁচে থাকার আশা সে হারিয়েছে। তাই সমস্ত পৃথিবীটা তার কাছে জীবস্মৃত বলে মনে হয়েছে।
প্রশ্নঃ ‘আমাদের কথা কে–বা জানে’ – ‘আমরা’ কারা? তাদের কথা কেন কেউ জানে না?
উত্তরঃ কবি শঙ্খ ঘোষের ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতা অনুসারে আমরা হল এই পৃথিবীর অগণিত অসহায় খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ।
     এই পৃথিবীর ইতিহাস আসলে ক্ষমতাবান শাসকের ইতিহাস। শাসকেরা প্রতিনিয়ত তার গতিপ্রকৃতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। তাদের মদতে বিভিন্ন স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ চরিতার্থ কেন কেউ আমাদের করার জন্য সমাজ রাজনৈতিক অস্থিরতার জন্ম জানে না দেয়, যার বলি হয় সাধারণ মানুষ। তাদের সুখ–দুঃখ–শান্তি স্বস্তির পরোয়া কেউ করে না। দুর্বল ও অসহায় আমজনতার কথা তাই কখনও সভ্যতার আয়নায় ধরা দেয় না। তাদের জন্য জোটে উপেক্ষা, অবহেলা ও বিস্মৃতি। কবি এই ঐতিহাসিক সত্যকেই তুলে ধরেছেন।
প্রশ্নঃ ‘আমরাও তবে এইভাবে/এ মুহূর্তে মরে যাব না কি’ – কবির এই অশঙ্কার কারণ কী? 
উত্তরঃ কবি শঙ্খ ঘোষের লেখা ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতা থেকে প্রশ্নে উল্লেখিত অংশটি গৃহীত। এখানে কবির এমন শঙ্কার কারণটি অত্যন্ত মর্মগ্রাহী। যেখানে আমরা আমাদের শিশুদের অস্তিত্ব রক্ষায় অপারগ, যেখানে প্রাণঘাতী হানাহানির অনায়াস শিকার হচ্ছে আমাদের শিশুরা; সেখানে নিজেদের অস্তিত্বের প্রশ্নটিও অবান্তর ও অর্থহীন হয়ে ওঠে। কারণ কবি কেবল বেঁচে থাকার জন্যই বেঁচে থাকাকে ঘৃণা করেন। তাই এহেন নারকীয় প্রবলের কাছে নতিস্বীকার এক সংবেদনশীল মানুষের কাছে অত্যন্ত যন্ত্রণা ও অপমানের বিষয়। পাঠ্য উদ্ধৃতাংশে সেই হতাশা ও অনুশোচনারই প্রকাশ ঘটেছে।

(৪) রচনাধর্মী প্রশ্নগুলির উত্তর দাও :

প্রশ্নঃ ‘আমাদের ডানপাশে ধ্বস/আমাদের বাঁয়ে গিরিখাদ’ – সমগ্র কবিতার পরিপ্রেক্ষিতে এই মন্তব্যের তাৎপর্য লেখো।

উত্তরঃ উদ্ধৃত অংশটি কবি শঙ্খ ঘোষের ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতার অংশবিশেষ। সংশয়ার্কীর্ণ ইতিহাসের রূপ সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন ও সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্পে আজকের পৃথিবী বিষাক্ত হয়ে উঠেছে। মানুষের অস্তিত্ব আজ বিপন্ন। এই সময়ে আমরা বিশেষ করে সাধারণ মানুষ এক ভয়ংকর দুঃসময়ের মধ্যে দিয়ে চলেছি। আমরা ডাইনে–বাঁয়ে বিপদকে রেখে, মাথার ওপর হানাদারি শত্রুকে উপেক্ষা করে, সামনের প্রতিকূল পথ ধরে এগিয়ে চলেছি। এ ছাড়া আমাদের সামনে আর কোনো পথ নেই। ভাবী প্রজন্মকে রক্ষা করতে আমরা ব্যর্থ। প্রতিক্ষণে হানাদারি মৃত্যুর ভয়ে আমরা ভীত। সাম্রাজ্যবাদী ও সুবিধাবাদী শক্তির কাছে আজ আমরা পর্যুদস্ত। কিন্তু আমাদের এই দুঃখের ইতিহাস অলিখিতই রয়ে যাবে চিরকাল। রানারের বেদনার মতো কালোরাত্রির খামে চিরকাল তা আবদ্ধ থেকে যাবে, এটাই কবির আক্ষেপ।

বিশ্বাসের ভিত যেখানে আলগা হয়ে যায়, সেখানেই সংশয়ের সৃষ্টি হয়। কবি মনে করেন, সারাপৃথিবীর ইতিহাসে সাধারণ মানুষের কথা সঠিকভাবে প্রতিফলিত হয়নি। কারণ ইতিহাসকে কবির দৃষ্টিতে আমাদের ইতিহাস নিয়ন্ত্রণ করে শাসক ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি। আর সাধারণ মানুষের যদিও বা কোনো ইতিহাস থাকে তবে তা অস্পষ্ট, অর্ধসত্য এবং অসম্পূর্ণ। ক্ষমতাবান শাসকের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ইতিহাসে মানুষের অবস্থার যথার্থ প্রতিফলন ঘটে না। তাদের অসহায় বিপন্নতা কিংবা জীবন্মুত পরিস্থিতির খোঁজ, শাসকের ইতিহাসে অনুপস্থিত বলেই তথাকথিত বিকৃত ইতিহাস সম্পর্কে কবির এই সংশয়।

প্রশ্নঃ ‘আমাদের ইতিহাস নেই’ – কাদের, কেন ইতিহাস নেই? এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে সভ্যতার কোন্ কলঙ্কিত ইতিহাসকে বোঝাতে চাওয়া হয়েছে?

উত্তরঃ ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় কবি সারাপৃথিবীর খেটে খাওয়া সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের ইতিহাসহীনতার প্রতি দিক্‌নির্দেশ করেছেন। আসলে এই বিশ্বের ইতিহাস লিপিবদ্ধ হয়। শাসক কিংবা সাম্রাজ্যবাদীর ইচ্ছা আর পরিকল্পনায়। তাই সেখানে উপেক্ষিত দুর্বলের বাস্তব অবস্থার যথার্থ প্রতিচ্ছবি কখনোই ফুটে ওঠে না। ক্ষমতাবানের দত্ত আর আস্ফালনে শিকড়হারা মানুষের সম্পূর্ণ বিস্মৃত দৈন্যদশাটি আমাদের ইতিহাস নেই এই শব্দবন্ধের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।

কলঙ্কিত ইতিহাসের পরিচয় বর্তমান সময়ে হিংসা ও রণরক্তে পর্যুদস্ত সাধারণ মানুষের দুরবস্থার কথা বলতে গিয়ে কবি ইতিহাসের প্রসঙ্গকে টেনে এনেছেন। কোনো দেশ কিংবা জাতির সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিবর্তনের ধারাবাহিক ভাষ্য আর বিশ্লেষণকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে মানুষের ইতিহাস। কিন্তু প্রথাগত ইতিহাস বা ক্ষমতাবানের পরিকল্পিত ইতিহাসে প্রাধান্য পায় শাসকের স্বার্থ। সেখানে বিকৃতি বিভ্রান্তি ও মিথ্যা প্রচারে প্রকৃত ইতিহাস তার নিজস্বতা হারায়। সাধারণ মানুষ ক্রমশ ভুলে যেতে থাকে নিজের ঐতিহ্য–শিকড়–স্বপ্ন ও সংঘর্ষের ইতিবৃত্তকে। তারা দিশাহীন বিচ্ছিন্নতার স্রোতে ক্রমশ পথ হারায়। তাই কবি আমজনতার ইতিহাস থাকা না থাকার সঙ্গে যখন ‘এমনই ইতিহাস’ লেখেন তখন মানুষের বিভ্রান্তির দিকটিও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শাসকের উদ্দেশ্যপূরণ করে এমন চাপিয়ে দেওয়া মিথ্যা ইতিহাসের কলঙ্কিত রূপটিকেই তাই কবি এভাবে কটাক্ষ করেছেন।

প্রশ্নঃ ‘তবু তো কজন আছি বাকি

আয় আরো হাতে হাত রেখে

আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ – কবিতাটির মধ্যে কবি যে মূল বক্তব্য তুলে ধরতে চেয়েছেন, তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। এর প্রেক্ষিতে কবির মানসিকতার পরিচয় দাও।

উত্তরঃ শঙ্খ ঘোষের ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় ‘বেঁধে বেঁধে’ থাকি বলতে কবি সংঘবদ্ধভাবে বেঁচে থাকাকে বোঝাতে চেয়েছেন। বর্তমান বিশ্ব ক্ষমতাবান শাসক, সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও মৌলবাদীদের যৌথ ষড়যন্ত্রে বিধ্বস্ত। মানুষ আজ বিপন্ন। প্রতি পদে পদে তার বিপদ। তার মাথার উপর ছাদ নেই। তারা তাদের ভাবী প্রজন্মকে রক্ষা করতে অক্ষম। এমনকি তারা নিজেরাই প্রতি মুহূর্তে প্রাণসংশয়ের ভয়ে ভীত। তাই এভাবে ক্রমাগত শোষিত মানুষগুলিকে কবি প্রত্যাঘাতের পথে এগোতে বলেছেন। এই প্রত্যাঘাতের পথ হল সংঘবদ্ধতা। কবি পৃথিবীর অংসখ্য শ্রমজীবী, শান্তিকামী সাধারণ মানুষদের ‘বেঁধে বেঁধে’ অর্থাৎ একত্রিত হয়ে এই সমস্ত প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে বলেছেন।

বন্য জীবজন্তুর হাত থেকে নিজেদের রক্ষার্থে আদিম অরণ্যচারী মানুষের মনেও একদিন সংঘবদ্ধভাবে বাস করার ভাবনা জেগেছিল। এইভাবেই গড়ে উঠেছিল পরিবার, পাড়া, গ্রাম, প্রদেশ ও রাষ্ট্র। সৃষ্টি হয়েছিল নতুন নতুন সভ্যতা। আজ বন্য জন্তুর ভয়ে নয়; সাম্রাজ্যবাদী, ক্ষমতাবান ও মৌলবাদী শক্তি তাদের নৃশংসতায় সাধারণ মানুষের সামনে অস্তিত্বের সংকট সৃষ্টি করেছে। এই সংকট থেকে রক্ষা পেতে, ভাবী প্রজন্মের কাছে এক সুন্দর পৃথিবী রেখে যেতে হলে প্রয়োজন মানুষের সংঘবন্ধতা। সুস্থ–শান্তিকামী ও বিবেকমান মানুষের ঐক্যবদ্ধ অঙ্গীকারেই একমাত্র এই সভ্যতার সংকটমোচন সম্ভব, কবি এ কথাই বলেছেন।

প্রশ্নঃ ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতায় কবি শঙ্খ ঘোষ সময় ও সমকাল সম্পর্কে যা বলতে চেয়েছেন, তা আলোচনা করো। 

উত্তরঃ বর্তমান সমাজব্যবস্থা উত্তর শঙ্খ ঘোষের ‘আয় আরো বেঁধে বেঁধে থাকি’ কবিতাটি আমাদের পাঠ্য বইয়ের চারপাশের পৃথিবী ভাবমূলের অন্তর্গত। বর্তমান সমাজের নৈতিক অবক্ষয় ও বিশৃঙ্খলা কবিকে পীড়িত করেছে। তাই মানুষের চলার পথের প্রতিকূলতা, অসহায়তা, সংশয় ও সম্ভাবনার ছবি কবি এই কবিতায় তুলে ধরেছেন। বর্তমান সময়ে মানুষের চলার পথ বিপৎসংকুল। তাদের চারপাশে মৃত্যুর হাতছানি, প্রতিপাদে বাধা আর প্রতিকূলতা। অবক্ষয়ের কার্য রূপ তার চলার সব পথ রুদ্ধ। তবু মানুষ এগিয়ে চলেছে। হানাদারি শত্রুর আঘাতে মানুষ নিরাশ্রয় হয়েছে। সে তার ভাবী প্রজন্মকে রক্ষা করতে গিয়ে হয়েছে ব্যর্থ। এখন সে নিজেও মৃত্যুভয়ে শঙ্কিত ও পথহারা। এমন পরিস্থিতিতে কবি ‘বেঁধে বেঁধে’ অর্থাৎ শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের সংঘবদ্ধ হয়ে চলার কথা বলেছেন।

কবির মতে, সাম্রাজ্যবাদী আর সুবিধাবাদী শক্তির কাছে আজ আমরা কোণঠাসা। আমাদের এই দুঃখযন্ত্রণার ইতিহাস হয়তো অলিখিতই রয়ে যাবে চিরকাল। অথবা যদি লেখা হয় তবে তা হবে অর্ধসত্য এবং অসম্পূর্ণতায় ভরা।

সাধারণ শ্রমজীবী মানুষদের চিরকাল এভাবেই আশাবাদী কবির আহ্বান ক্ষমতাবানের প্রতিবন্ধকতার সঙ্গে যুঝে বেঁচে থাকতে হয়। পৃথিবীর এই জীবন্মুত পরিস্থিতিতে অন্যের দোরে দোরে পরমুখাপেক্ষী হয়ে না – ঘুরে, নৈরাশ্য ত্যাগ করে তাই আমাদেরই একত্রিত হতে হবে। কবির আহ্বান বিবেকবান মানুষের একতা ও সাহচর্যই হবে। তাদের প্রতিরোধের ভাষ্য।

©kamaleshforeducation.in(2023)

 

 

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!