2016 সালের টিচিং এবং নন টিচিং স্টাফদের নিয়োগ বাতিল করে রায় দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট। এটি একটি দীর্ঘ রায়। দুর্বোধ্যও বটে। সমগ্র রায়টাকে সহজে বলার চেষ্টা করলাম। এটা পড়লে এই বহুচর্চিত বিষয়টির পুরোটা পরিষ্কার হবে।
———————————————————–——————————
১) তিন ধরণের আবেদনকারী ছিলেন এই মামলায়
ক ) সেই সমস্ত কর্মী যাঁদের অন্যায় কাজের সুনির্দিষ্ট প্রমাণ আছে ( Tainted )
(খ) সেই সমস্ত কর্মী যাঁরা দাবি করেছেন যে তাঁরা সঠিকভাবে নিয়োগ পেয়েছেন ( Untainted)
( গ) রাজ্য সরকার ও এসএসসি।
২) উপরে ( ক) তে বর্ণিত আবেদনকারীদের ( Tainted দের ) বক্তব্য হলো হাই কোর্ট তাদের চাকরি বাতিলের রায় দিয়েছে যে তথ্য প্রমাণের উপরে ভিত্তি করে সেটা যথার্থ নয়। অর্থাৎ সিবিআই কর্তৃক উদ্ধারকৃত হার্ড ডিস্কের তথ্য যেটার উপর ভিত্তি করে segregation দাবী করেছে বৈধরা সেটার বৈধতাকেই অস্বীকার করেছেন এই আবেদনকারীরা। তাছাড়া তাঁদের বক্তব্য তাঁদেরকে যথাযথ তদন্ত ছাড়াই শাস্তি দেওয়া হয়েছে। এটা ন্যাচারাল জাস্টিস এর পরিপন্থী।
৩) উপরে (খ) আর (গ) তে বর্ণিত আবেদনকারীদের অর্থাৎ Untainted Candidate ও সরকার পক্ষের দাবি হলো যে হাইকোর্ট সমগ্র প্যানেল বাতিল করে ভুল করেছে। তার উচিত ছিল শুধুমাত্র (ক) তে বর্ণিত ক্যান্ডিডেটদের অর্থাৎ Tainted দের চাকরি বাতিল করা এবং বৈধদের ( Untainted দের) চাকরি বজায় রাখা।
৪) 2016 সালে এসএসসি IX -X , XI -XII লেভেলে AT, গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি করে। NYSA নামে একটা কোম্পানিকে এই পরীক্ষাগুলির OMR sheet scanning ও রেজাল্ট তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয়।
৫) এই পরীক্ষার রেজাল্টে সবার মার্কস ডিসপ্লে করা হয়নি। শুধুমাত্র ইন্ডিভিজুয়াল ক্যান্ডিডেটরা তাদের নিজেদের মার্কসটাই দেখতে পেরেছিল। এরপর পার্সোনালিটি টেস্ট হয়।
৬) এরপর ফাইনাল রেজাল্ট আউট হয়। তাতেও সবার মার্কস আপলোড হয়নি। সেখানে এমপ্পানেলড আর ওয়েটিং লিস্ট এর নাম দেখানো হয়।
৭) কলকাতা হাইকোর্টে ২০১৬ সালে প্রথম মামলা করেন বৈশাখী ভট্টাচার্য নামে একজন প্রার্থী age relaxation এর দাবিতে। এরপর ২০২১ সালে একাধিক রিট পিটিশন দাখিল হয় বেশ কয়েকটি ইস্যুতে। যেমন – অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার পাওয়া সত্ত্বেও জয়েন করতে না পারা, চতুর্থ ফেজ এর কাউন্সেলিং না করা, rank jumping, recruitment rules না মেনে যাকে তাকে নিয়োগ, মেরিট লিস্টের বাইরের ক্যান্ডিডেট নিয়োগ।
৮) এই বেনিয়মগুলির অনেক গুলিই WBSSC স্বীকার করে নেয় তাদের ভুল বলে। WBSSC কে আদালত প্রশ্ন করলে তারা উত্তরে বলে যে তারা বেনিয়মের নিয়োগের সঠিক তথ্য দিতে সক্ষম নয়।
এছাড়া WBSSC অরিজিনাল OMR শিট দেখাতে পারেনি। কিন্তু স্ক্যানড কপি দেয়। পরে আবার বলে যে ওগুলি তাদের কাছে ছিল না। ওগুলি তারা পেয়েছে NYSA এর কাছ থেকে।
৯) WBSSC তাদের রিক্রুটমেন্ট RULES এর উল্লেখ করে বলে যে ঐ RULES অনুযায়ী তারা রেজাল্ট বেরনোর এক বছর পর অরিজিনাল OMR শিট ধ্বংস করে ফেলেছে। এটা AT দের ক্ষেত্রে এটা কিছুটা সত্য হলেও কোনো RULES এ লেখা নেই যে এক বছর পর গ্রুপ সি/ গ্রুপ ডি রিক্রুটমেন্ট এর OMR SHEET ও ধ্বংস করে ফেলা যাবে।
১০) অ্যাপয়েন্টমেন্ট এ বেনিয়ম লক্ষ্য করে WBSSC কিছু AT এর SERVICE TERMINATE করে। ( বিঃ দ্রঃ – এখানে এটা একটা প্রিন্টিং MISTAKE হতে পারে। সম্ভবত এটা WBBSE বলতে চাওয়া হয়েছে। অথবা রেকমেন্ডেশন ক্যান্সেল করে। সার্ভিস টারমিনেট করার ক্ষমতা WBSSC এর নেই )। উচ্চ আদালতের ( হাই কোর্ট ) নির্দেশেও WBSSC কিছু রেকমেন্ডেশন উইথড্র করে।
১১) এরপর হাই কোর্টের সিঙ্গেল জজ সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন।
১২) এর বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আসে ব্যাপারটা। তখন সুপ্রিম কোর্ট সিবিআই তদন্তের নির্দেশ বহাল রাখে এবং হাই কোর্টের ডিভিশন বেঞ্চে পাঠিয়ে দেয় মামলাটা।
১৩) সিবিআই চারটি অন্তর্বর্তী রিপোর্ট ও একটা ফাইনাল রিপোর্ট পেশ করে।
১৪) এর পর হাইকোর্ট ২২/০৪/২০২৪ তারিখের অর্ডারে সমগ্র নিয়োগ প্রক্রিয়াটাকেই বাতিল করে দেয়। এবং ডিভিশন বেঞ্চ এই নির্দেশগুলি দেয় –
ক) সমস্ত অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল
খ) তিনটে হার্ড ডিস্ক থেকে প্রাপ্ত সমস্ত OMR SHEET ওয়েবসাইটে আপলোড করতে হবে।
গ) যারা ব্ল্যাঙ্ক OMR দিয়ে, প্যানেলের বাইরে থেকে, অথবা EXPIRED প্যানেল থেকে নিযুক্ত হয়েছিল তাদের ১২ % সুদ সহ রাজ্য সরকারের কাছে চার সপ্তাহের মধ্যে টাকা ফেরত দিতে হবে।যদি এই টাকা নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফেরত না দেয় তাহলে জেলার ডি এম সেই amount টা land revenue এর arrear হিসাবে তার কাছ থেকে ছয় সপ্তাহের মধ্যে আদায় করবে।
ঘ) ডি আই সেই জেলার ডি এম কে এই টাকা ফেরতের ব্যাপারটা রিপোর্ট করবেন।
ঙ) সিবিআই এর পরেও তদন্ত চালিয়ে যাবে।
চ) পূর্বে ঘোষিত ভ্যাক্যানসিগুলির জন্য এসএসসি ফ্রেশ সিলেকশন প্রসেস চালাবে।
ছ) এসএসসি recruitment rules ফলো করে উক্ত সিলেকশন প্রসেস চালাবে।
১৫) এরপর বিভিন্ন কেসের রেফারেন্স দিয়ে বোঝানো হয় কোর্ট কেন সমগ্র প্যানেল বাতিল করছে।
১৬) সুপ্রিম কোর্ট কয়েকটি নীতিমালার উপর ভিত্তি করে এই প্যানেল ক্যান্সেল এর সিদ্ধান্তে এসেছে । সেগুলি হলো –
ক) যখন সিস্টেমেটিক বেনিয়ম হয় তখন সমগ্র সিলেকশন প্রসেসটাই বাতিলের যোগ্য হয়ে যায়।
খ) যদি একটা সিলেকশন প্রসেসকে ক্যান্সেল করতে হয় তাহলে প্রচুর উপাদান সংগ্রহ করতে হয় সেই বেনিয়ম যে বিশাল আকারের ছিল সেটা প্রমাণ করার জন্য। তবে সব ক্ষেত্রেই এরকম বাধ্যবাধকতা নেই যে ঐ সমস্ত মেটেরিয়াল দিয়ে আদ্যোপান্ত সবগুলি কেস বেনিয়ম করে হয়েছে এটা প্রমাণ করতেই হবে। যদি লার্জ স্কেলে দূর্নীতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায় তাহলে সেটাই একটা প্রসেসকে বাতিল করার জন্য যথেষ্ট।
গ) Untainted ক্যান্ডিডেটদের সঙ্গে কিছু অবিচার হয়ে যেতে পারে। কিন্তু যখন গভীর দূর্নীতির করাল ছায়া পড়ে তখন একটা সিলেকশন প্রসেসের শুদ্ধতা রক্ষা করার জন্য এই রকম কঠিন সিদ্ধান্ত নিতেই হয়।
ঘ) প্রত্যেক ভুক্তভোগীকে ইন্ডিভিজুয়াল নোটিশ দেওয়া এবং তার বক্তব্য শোনার দরকার নেই যখন এটা প্রমাণিত হয়ে গেছে একটা সিলেকশন প্রসেসের সমগ্রটা বেনিয়মের দ্বারা পরিচালিত হয়েছে।
১৭) সুপ্রিম কোর্টের মতে এই সিলেকশন প্রসেসে এমন বেনিয়ম করা হয়েছে যা সমগ্র প্রসেসটাকেই কলঙ্কিত করেছে যার নিরাময় সম্ভব নয়।
১৮) সুপ্রিম কোর্ট এবার এই দুর্নীতির ব্যাপারে হাই কোর্টের অবজারভেশন গুলির একটা রেফারেন্স দিয়েছে । সেগুলি হলো —
ক) ওপেন টেন্ডার ছাড়া NYSA কে স্ক্যানের দায়িত্ব দিয়েছিল এসএসসি। NYSA আবার অন্য একটা এজেন্সিকে ( Data Scantech) দায়িত্ব হস্তান্তর করেছিল OMR স্ক্যান করার জন্য।
খ) এসএসসি OMR শিট গুলিকে নষ্ট করে ফেলেছিল তাদের সার্ভারে মিরর ইমেজ না রেখেই।
গ ) ঘোষিত ভ্যাক্যান্সির চেয়ে বেশি সংখ্যায় অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া হয়েছে
ঘ) প্যানেলের বাইরে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া হয়েছে।
ঙ) ব্ল্যাঙ্ক OMR শিট জমা দিয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেয়েছে অনেকে।
চ) প্যানেল expire করে যাওয়ার পরও অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া হয়েছে।
ছ) Rank jump করে অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া হয়েছে।
জ) মেরিট লিস্টে ক্যান্ডিডেটদের মার্কস উল্লেখ করা হয়নি।
ঝ) এসএসসি, বোর্ড, এবং সরকার টোটাল বেনিয়মের সংখ্যা নিশ্চিত করে বলতে অক্ষম।
ঞ ) Recruitment Rules মেনে নিয়োগ প্রক্রিয়া চালানো হয়নি।
১৯) এইবার সুপ্রিম কোর্ট বাগ কমিটির রিপোর্ট এর অবতারণা করতে গিয়ে গ্রূপ সি ও গ্রূপ ডি স্টাফের নিয়োগের ক্ষেত্রে যে বেনিয়মগুলি তুলে ধরে —
Rank change, যথাযথ ভাবে rank প্রকাশ না করা, কমিশনার বিভিন্ন অফিসারদের প্রত্যক্ষভাবে দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকা।
২০) এরপর সিবিআই এর রিপোর্ট গুলির ( চারটে) উল্লেখ করা হয়। এগুলিতে যা ছিল সেগুলি হলো —
ক) সিবিআই এসএসসি অফিসের সার্ভারের database seized করেছিল। তারা আবার গাজিয়াবাদ থেকে NYSA এর প্রাক্তন কর্মী পঙ্কজ বনশালের কাছ থেকে তিনটি হার্ড ডিস্ক উদ্ধার করে যাতে OMR এর স্ক্যানড কপিগুলি ছিল। এভিডেন্স অ্যাক্ট, 1872 এর 65 B অনুসারে উক্ত পঙ্কজ বনশাল নামক ব্যক্তির থেকে সার্টিফিকেট নেওয়া হয় যাতে ঐ হার্ড ডিস্কের ডাটা জেনুইন ছিল বলে উল্লেখ করা হয়।
খ) বিভিন্ন টেকনিক্যাল এনালাইসিস করে ঐ ডাটা এর genuineness সম্বন্ধে নিশ্চিত হয় সিবিআই।
গ) তদন্তের সময় সিবিআই এসএসসির অফিসারদের বিভিন্ন ই মেল এর হদিশ পায় যেগুলি তাদের দুর্নীতির প্রমাণ দেয়। এগুলিতে অন্যায় ভাবে চাকরি পাইয়ে দেওয়ার প্রমাণ ছিল।
ঘ) নীলাদ্রি দাস, মোজাম্মেল হোসেন, পঙ্কজ বনশাল এরা NYSA ছাড়লেও বেআইনি ভাবে WBSSC এর রিক্রুটমেন্ট ডাটা গুলি নিজেদের হেফাজতে রেখেছিল এবং এসএসসি কে RTI এর তথ্য সরবরাহ করছিল। এটা একটা অশুভ আঁতাত এসএসসি এর অফিসারদের সঙ্গে এই দুর্নীতিবাজদের। এমনকি এই দুর্নীতিতে সাহায্য করার পুরষ্কার স্বরূপ নীলাদ্রি দাস কে আপার প্রাইমারি নিয়োগ সংক্রান্ত দায়িত্ব দিয়েছিল এসএসসি।
ঙ) পঙ্কজ বনশাল এর কাছ থেকে উদ্ধারকৃত হার্ড ডিস্কের মধ্যে রাখা OMR এর মার্কস এর সঙ্গে এসএসসি এর সার্ভারের মার্কস ম্যাচ করেনি। যাতে মার্কস বাড়িয়ে দুর্নীতির পরিষ্কার প্রমাণ পাওয়া যায়।
চ) পঙ্কজ বনশালের কাছ থেকে উদ্ধারকৃত হার্ড ডিস্কের ডাটা এর genuineness সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ছ) WBSSC কোন কোন ক্ষেত্রে ( প্যানেলের বাইরে নিয়োগ, Rank jump, OMR mismatch, ইত্যাদি ) কতগুলি করে বেনিয়মের নিয়োগ হয়েছে তার একটা সারসংক্ষেপ দিয়ে চারটে টেবিলে তথ্য প্রদান করে।
২১) 27/09/2022 এর এফিডেভিটে WBSSC বলে যেহেতু সিবিআই ইনভেস্টিগেশন এ প্রাপ্ত তথ্য এসএসসি কে দেয়নি তাই এসএসসি এর পক্ষে বেনিয়মের নিয়োগের সঠিক ও নিশ্চিত তথ্য দেওয়া সম্ভব নয়।
২২) পরে অবশ্য এসএসসি উপরে উল্লেখিত affidavit এর বয়ানের সংশোধন করে বলে যে এখন তারা সিবিআই এর থেকে ডাটা পেয়েছে এবং উদ্ধারকৃত স্ক্যানড কপিও দেখতে পাচ্ছে। এসএসসি এইবার পরিষ্কার করে বলে দেয় যে সিবিআই যে বেনিয়মের নিয়োগের তালিকা বানিয়েছে সেটাকে তারা মান্যতা দিচ্ছে এবং এবং ওটা ধরেই অবৈধদের বাদ দিয়ে বৈধদের চাকরি নিশ্চিত করা যায়। সুতরাং সমগ্র সিলেকশন প্রসেসটার বাতিলের প্রয়োজন নেই।
২৩) সুপ্রিম কোর্ট এরপর বলল যে তাঁরা এসএসসি এর উপরের বক্তব্য মেনে নিতে পারতেন যদি এসএসসি এর কাছে অরিজিনাল OMR গুলি বা তার মিরর কপিগুলি থাকতো। অর্থাৎ এসএসসি লিস্ট দিলেও সেটাকে গুরুত্ব দিল না কোর্ট।
২৪) এসএসসি বলল এবং সঠিক ভাবেই বলল যে তারা
Recruitment Rules এর Rule 21 অনুযায়ী এক বছর পর OMR নষ্ট করে দিয়েছে। এটা কিছু বেআইনি কাজ করেনি। কিন্তু কোর্টের বক্তব্য হলো এই Rule AT নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও
গ্রুপ সি ও গ্রুপ ডি নিয়োগের ক্ষেত্রে এরকম OMR নষ্টের নিয়ম Rules এ নেই। তাছাড়া এক বছর পার হলেও তখনও RECRUITENT প্রসেসটা চলছিল । তাই সেই অবস্থায় OMR নষ্ট করা ঠিক হয়নি।তাছাড়া WBSSC OMR এর মিরর কপি রাখেনি। এটা বেআইনী কাজ।
২৫) WBSSC প্যানেলের টার্ম RULES এর বাইরে গিয়ে এক্সটেনশন করেছিল। তারা কাউন্সেলিং ও অ্যাপয়েন্টমেন্ট এর রেকমেন্ডেশন দিয়েছিল প্যানেল এর ভ্যলিডিটি পার হয়ে যাওয়ার পর।
২৬) WBSSC OMR স্ক্যান নিয়ে যে সমস্ত দুর্নীতি করেছিল তার কথা আগেই বলা হয়েছে। WBSSC কোনও OMR এর মিরর কপি রাখেনি। যদিও প্রথম দিকে রেখেছিল। পরে delete করে দেয়।কিন্তু NYSA কে সেগুলি রাখতে দিয়েছিল। তারা স্ক্যানড কপি থেকে বেশ কিছু RTI এর রিপ্লাই দিয়েছিল এসএসসি। তখন বলেছিল যে এই তথ্য তাদের কাছেই ছিল। পরে বয়ান পাল্টে বলে সিবিআই এর থেকে প্রাপ্ত তথ্যই তারা দিয়েছে। তাদের কাছে তথ্য ছিল না। এইভাবে বারবার পরস্পর বিরোধী কথা বলেছে এসএসসি। সুপ্রিম কোর্ট মনে করেছে এগুলি ইচ্ছাকৃতভাবে দূর্নীতি করার জন্য করা হয়েছে।
২৭) WBSSC এর সার্ভারের মার্কস আর হার্ড ডিস্কের OMR এর মার্কস এর মধ্যে বিস্তর মিসম্যাচ ছিল। এ ছাড়া ই মেল গুলি থেকে দূর্নীতির স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে।
২৮) এসএসসি ক্যান্ডিডেটদের মার্কস আপলোড করেনি। এটা দুর্নীতির আভাস দেয়।
২৯) WBBSE যত অ্যাপয়েন্টমেন্ট লেটার দেয় তার সংখ্যা WBSSC কর্তৃক ইস্যু হওয়া রেকমেন্ডেশন লেটার এর সংখ্যার চেয়ে বেশি ছিল। এটা দূর্নীতি। প্রথমে এই ব্যাপারে বোর্ড ও এসএসসি এর মতামত ছিল পরস্পর বিরোধী। পরে অবশ্য বোর্ড এর একটা কারন বলে । তারা বলে যে এসএসসি এর সঙ্গে তাদের কোনো মিস ম্যাচ নেই। আসলে তারা প্রথমে যে সব ক্যান্ডিডেট জয়েন করেনি তাদের ধরে কাউন্ট করেছিলেন বলে এই ভুল হয়েছিল। এখন ঠিক আছে।
৩০) এরপর ঝামেলা পাকলো উদ্ধারকৃত হার্ড ডিস্কের OMR গুলির authenticity নিয়ে। Tainted ক্যান্ডিডেটরা বলল হার্ড ডিস্কের OMR গুলি তাদের পরীক্ষার OMR নয়। ওদিকে Untainted রা বলল হার্ড ডিস্কের OMR গুলি সত্যি করেই তাদের পরীক্ষার OMR।
৩১) Tainted ক্যান্ডিডেটরা দাবী করেন Evidence Act , 1872 এর 65 B অনুসারে যে সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছিল উদ্ধারকৃত হার্ড ডিস্কের ডাটা এর authenticity নিয়ে সেই সার্টিফিকেটগুলি গ্রহণযোগ্য নয় কারন যিনি দিয়েছিলেন Evidence Act অনুযায়ী সেগুলি দেওয়ার অথরিটি তাঁর ছিল না। এইখানে সুপ্রিম কোর্ট বলছে এই সমস্ত প্রাপ্ত ডাটা এর authenticity বা 65 B এর আন্ডারে নেওয়া সার্টিফিকেটগুলির গ্রহণযোগ্যতা বিচার করার কোনো দরকার নেই। ওটা ক্রিমিনাল কোর্টের আন্ডারে পড়ে। Evidence Act রিট পিটিশনের ক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রযোজ্য নয়। সুতরাং কোর্ট এই সব ব্যাপারে tainted ও untainted ক্যান্ডিডেটদের পরস্পর বিরোধী দাবিগুলি নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামাতে রাজি নয়। এখানে কোর্ট যেটাতে জোর দিচ্ছে সেটা হচ্ছে WBSSC OMR গুলির স্ক্যানড বা মিরর কপি রাখতে ব্যর্থ হয়েছিল । এটাই বিচার্য এখানে।
৩২)পঙ্কজ বনশাল কাছ থেকে উদ্ধারকৃত হার্ড ডিস্কের মধ্যে থাকা SCANNED OMR এর মার্কস আর এসএসসি এর কম্পিউটারে সংরক্ষিত মার্কস এর মধ্যে প্রচুর গরমিল ছিল। এসএসসি সেটা স্বীকারও করেছে।
৩৩) বনশালের থেকে উপরে উল্লেখিত তিনটি হার্ড ডিস্কের ডাটা আর Data Scantech থেকে প্রাপ্ত ডাটা এর মধ্যে কোনও উল্লেখযোগ্য গরমিল ছিল না। তাই এই ডাটা গুলিতে খুব গণ্ডগোল আছে এমন বলা যায় না। সুতরাং এইগুলি থেকে প্রাপ্ত তথ্য নির্দেশ করছে যে বড় আকারের বেনিয়ম হয়েছে বিভিন্ন ধরনের, যেমন – Rank jump, রেজাল্টের বিকৃতি, মার্কস এর গরমিল প্যানেলের বাইরে থেকে নিয়োগ, প্যানেলের ভ্যালিডিটি শেষ হওয়ার পর নিয়োগ ইত্যাদি ।
৩৪) WBSSC প্রথম থেকে চেষ্টা করেছে সত্য লুকোতে। তারা বেনিয়ম গুলোকে এমন ভাবে চাপা দিয়েছে যে সেখান থেকে সত্য খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।
৩৫) তদন্ত বা বিচার প্রক্রিয়া অনেক দেরীতে শুরু হয়েছে অর্থাৎ ক্যান্ডিডেটরা চাকরি পাওয়ার অনেক বছর পরে এটা শুরু হয়েছে তাই এই ব্যাপারে আর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত নয়। এই দাবী ছিল WBSSC এবং ক্যান্ডিডেটদের। কিন্তু কোর্ট এই দাবি মানেনি। কোর্টের মতে ব্যাপারটা জানা গেছে মাত্র 2021 বা 2022 সালে। তাই দেরীর জন্য মাফ এই নীতি এখানে প্রযোজ্য নয় কারন এখানে ইচ্ছাকৃতভাবে সত্য লুকানো হয়েছে। তাই এখানে মাফের প্রশ্ন নেই।
৩৬) ন্যাচারাল জাস্টিস এর থিওরি এখানে প্রযোজ্য হবে না কারন এখানে সমস্ত ডাটা দেখানোর এবং বক্তব্য বলার অধিকার সকলকে দেওয়া হয়েছিল। ন্যাচারাল জাস্টিস এর দোহায় দিয়ে এত বড় দুর্নীতিকে মেনে নেওয়া যায় না।
৩৭) সুপ্রিম কোর্ট এরপর পরিষ্কার বলল যে tainted candidates দের ক্ষেত্রে তাঁরা হাই কোর্টের রায় বহাল রাখছেন। অর্থাৎ এঁদের ক্ষেত্রে চাকরি বাতিল হবে এবং তাঁরা চাকরি থেকে যত রকমের স্যালারি বা পেমেন্ট পেয়েছেন সব ফেরত দিতে হবে।
৩৮) যে ক্যান্ডিডেটদের নির্দিষ্টভাবে tainted বলে প্রমাণ করা যায়নি তাঁদের চাকরিও বাতিল হবে যেহেতু সমগ্র সিলেকশন প্রসেসটাই বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে। তবে তাঁদের কোনো বেতন বা পেমেন্ট ফেরত দিতে হবে না। এদেরকে নতুন করে নিয়োগও করা যাবে না আর একবার সিলেকশন প্রসেস না চালিয়ে।
৩৯) যে সমস্ত ক্যান্ডিডেট এই চাকরিতে আসার আগে অন্য কোথাও কর্মরত ছিলেন তাঁরা তাঁদের পূর্বের চাকরিতে ফিরে যাওয়ার জন্য সেই ডিপার্টমেন্টে আবেদন করতে পারবেন। তাঁদের আবেদন তিন মাসের মধ্যে প্রসেস করা হবে। সেই আগের চাকরি ছেড়ে আসার দিন থেকে আবার সেখানে জয়েন করার দিন পর্যন্ত সময়টা সার্ভিস continuation পাবেন এবং সেই সময়ে যে ইনক্রিমেন্টগুলি প্রাপ্য ছিল সেগুলিও পাবেন। কিন্তু মাঝের সময়টার জন্য আগের ডিপার্টমেন্ট থেকে কোনো বেতন পাবেন না। তাঁদের আগের ডিপার্টমেন্টে ফিরিয়ে দেয়ার জন্য প্রয়োজনে supernumerary পোস্ট তৈরি করতে হবে।
৪০) শারীরিক ভাবে অসুস্থ সোমা দাস এর চাকরি মানবিক কারনে বহাল থাকবে । অন্য প্রতিবন্ধী কর্মীদের চাকরিও বহাল থাকবে ফ্রেশ সিলেকশন প্রসেস কমপ্লিট হওয়া পর্যন্ত।
৪১) সমস্ত Untainted ক্যান্ডিডেটরা ফ্রেশ সিলেকশন প্রসেসে অংশ নিতে পারবেন। তাঁরা বয়সের ছাড়ও পাবেন।
৪২) ক্রিমিনাল প্রসিডিংসগুলি কেমন চলছে চলবে। এই জাজমেন্ট সেগুলিকে প্রভাবিত করবে না।
৪৩) সমগ্র সিলেকশন প্রসেসটাকেই বাতিল করার হাইকোর্টের রায় সুপ্রিম কোর্ট বহাল রাখছে । যদিও অন্যান্য ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন করছে।
৪৪) Supernumerary পোস্ট নিয়ে হিয়ারিং হবে এপ্রিলের আট তারিখে।
৪৫) এই ব্যাপারে সমস্ত আবেদনগুলির নিষ্পত্তি হলো। —
আমার কথা — এই রায়ে ব্যাপক দূর্নীতির কথা পরিষ্কার হয়েছে। বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের তাতে ভূমিকা আছে। কিন্তু এটা পরিষ্কার হলো না যে Untainted ক্যান্ডিডেটদের বিরুদ্ধে কী প্রমাণ কোর্ট পেল যার দায়ে তাদের চাকরি বাতিল হয়ে গেল ? দোষ করেছে কর্তৃপক্ষ। তার দায়ে প্রমাণ ছাড়াই হাজার হাজার মানুষের মুখের ভাত কেড়ে নেওয়া যায় ? অন্যের অপরাধের দায়ে তাঁদেরকে কেন ন্যাচারাল জাস্টিস থেকে বঞ্চিত করা হবে ? প্রশ্নগুলি থেকেই গেল।
SOURCE-SMR