যে অতি মন্থর, কিন্তু অবিরাম ও গতিশীল পরিবর্তন প্রক্রিয়ার দ্বারা উদ্বংশীয় (পূর্বপুরুষ) সরল জীব থেকে নতুন প্রকারের জটিলতর ও উন্নত জীবের উদ্ভব ঘটে তাকে বিবর্তন বা জৈব অভিব্যক্তি বলে।
যে সমস্ত অঙ্গ উৎপত্তি বা অন্তর্গঠনগতভাবে এক হলেও বহিরাকৃতি ও কার্যগতভাবে পৃথক, তাদের সমসংস্থ বা হোমোলোগাস অঙ্গ বলে। যেমন — পাখির ডানা ও মানুষের হাত।
যে সমস্ত অঙ্গ উৎপত্তি বা অন্তর্গঠনগতভাবে ভিন্ন প্রকারের হলেও বহিরাকৃতি ও কার্যকারিতার দিক থেকে একই প্রকারের, তাদের সমবৃত্তীয় বা অ্যানালোগাস অঙ্গ বলে। যেমন — বাদুড়ের প্যাটাজিয়াম ও পতঙ্গের ডানা।
জীবদেহে যে সমস্ত অঙ্গ তাদের পূর্বপুরুষদের দেহে এবং সম্পর্কিত অন্য জীবের দেহে সক্রিয় থাকলেও সংশ্লিষ্ট জীবটির দেহে কর্মক্ষমতা হারিয়ে নিষ্ক্রিয় অঙ্গে পরিণত হয়েছে সেইসব অঙ্গকে লুপ্তপ্রায় অঙ্গ বলে। যেমন — মানুষের কক্সিস।
পৃথিবীর অভ্যন্তরে প্রাচীন পাললিক শিলাস্তরে যুগ যুগ ধরে সংরক্ষিত অধুনালুপ্ত উদ্ভিদ কিংবা প্রাণীদেহের সামগ্রিক বা আংশিক প্রস্তরীভূত রূপ বা ছাপকে জীবাশ্ম বা ফসিল বলে। যেমন — আরকিওপটেরিক্স-এর জীবাশ্ম।
ডারউইনের তত্ত্ব অনুসারে, জীবের যেসব বৈশিষ্ট্য তাকে জীবনসংগ্রামে টিকে থাকতে সাহায্য করে তাদের অনুকুল প্রকরণ বলে। অপরপক্ষে, জীবের যেসব বৈশিষ্ট্য জীবকে কোনোভাবেই জীবনসংগ্রামে টিকে থাকায় সাহায্য করে না, তাদের প্রতিকূল প্রকরণ বলে।
বিবর্তন-সংক্রান্ত ব্যবহার ও অব্যবহারের সূত্র এবং অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ মতবাদের জন্য ল্যামার্ক বিখ্যাত।
যে সমস্ত প্রাণী বা উদ্ভিদ বহুকাল পূর্বে উৎপত্তি লাভ করে আজও তাদের অপরিবর্তিত রূপ নিয়ে পৃথিবীতে বেঁচে আছে, যদিও তাদের সমসাময়িক ও সমগোত্রীয় জীবেরা বহুকাল আগেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে, তাদের জীবন্ত জীবাশ্ম বা লিভিং ফসিল বলে। যেমন — লিমিউলাস (প্রাণী), গিংকগো বাইলোবা (উদ্ভিদ) ইত্যাদি।
প্রাচীন পৃথিবীর পরিবেশে উপস্থিত বিভিন্ন সরল রাসায়নিক উপাদান (মৌল ও যৌগ) থেকে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে জীবের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ জৈব যৌগ সৃষ্টির ধারাবাহিক ঘটনাকে কেমোজেনি বা জীবনের রাসায়নিক উৎপত্তি বলে। বিজ্ঞানী হ্যালডেন ও ওপারিন কেমোজেনির পর্যায়গুলি বর্ণনা করেন।
জীবের রাসায়নিক উৎপত্তির দ্বিতীয় পর্যায়ে সরল যৌগ থেকে জটিল যৌগের উৎপত্তির সময়ে মুক্ত নিউক্লিওটাইডগুলি পরস্পর যুক্ত হয়ে পলিনিউক্লিওটাইড বা নিউক্লিক অ্যাসিড সৃষ্টি করে। একে নগ্ন জিন বলে। এটি কোনোরূপ আবরণে আবৃত ছিল না।
মনে করা হয় প্রোটোসেল বা আদিকোশে প্রথম জেনেটিক উপাদান ছিল RNA। পরবর্তীকালে DNA মূল জেনেটিক উপাদানরূপে আত্মপ্রকাশ করে। অর্থাৎ, RNA থেকে DNA-এর অবির্ভাব ঘটে। এই ধারণাকে বলে RNA পৃথিবী প্ৰকল্প বা RNA ওয়ার্ল্ড হাইপোথেসিস।
ল্যামার্কের মতে, জীবদেহের কোনো অঙ্গ ক্রমাগত ব্যবহৃত হতে থাকলে অঙ্গটি শক্তিশালী, সুগঠিত ও সবল হয়। পক্ষান্তরে, জীবদেহের কোনো অঙ্গ দীর্ঘদিন অব্যবহারের ফলে দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় হয়ে অবশেষে অবলুপ্ত হয়ে যায়। যেমন — মানুষ যে হাতটি বিভিন্ন কাজে বেশি ব্যবহার করে সেটি অন্য হাতের তুলনায় বেশি সক্রিয় এবং সবল হয়।
পরিবেশের প্রভাবে অভিযোজনগতভাবে জীব যেসব বৈশিষ্ট্য অর্জন করে সেইসব বৈশিষ্ট্য বংশানুক্রমে সন্তানসন্ততির দেহে সঞ্চারিত হয়। এইভাবে কোনো জীবের পর্যায়ক্রমিক বংশগুলিতে নতুন বৈশিষ্ট্যগুলির অর্জন ও বংশানুসরণ হওয়ার ফলে অনেকগুলি প্রজন্ম বাদে সৃষ্ট জীবটি পূর্বপুরুষ থেকে পৃথক হয়ে যায়। এইভাবেই নতুন প্রজাতির সৃষ্টি হয়। ল্যামার্কের এই মতবাদকে অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ বলা হয়।
আদিম পৃথিবীতে সমুদ্রের উত্তপ্ত জলে শর্করা, অ্যামিনো অ্যাসিড ও প্রোটিন প্রভৃতি জটিল জৈব যৌগ যুক্ত হয়ে একটি কোলয়েড কণা গঠন করে। বিজ্ঞানী ওপারিন এর নাম দেন কোয়াসারভেট। এগুলি দ্বিস্তরীয় পর্দাবেষ্টিত, গোলাকার ও বিভাজনে সক্ষম। বিজ্ঞানী ওপারিনের মতে পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের সৃষ্টি হয়েছিল কোয়াসারভেট থেকে।
প্রাচীন পৃথিবীতে সমুদ্রের মধ্যে অ্যামিনো অ্যাসিড থেকে প্রথমে প্রোটিনয়েড সৃষ্টি হয়, যা পরবর্তীকালে প্রাণ সৃষ্টির প্রকৃতস্থান হিসেবে কাজ করে। এইগুলি একত্রিত হয়ে মাইক্রোস্ফিয়ার গঠন করে। এগুলি দ্বিস্তরীয় পর্দাবেষ্টিত ও বিভাজনে সক্ষম। বিজ্ঞানী সিডনি ফক্স-এর মতে প্রথম প্রাণ সৃষ্টি হয়েছিল মাইক্রোস্ফিয়ার থেকে, কোয়াসারভেট থেকে নয়।
উচ্চতাপ ও অতিবেগুনি রশ্মির প্রভাবে প্রোটিন ভেঙে অথবা নিম্ন উয়তায় শুষ্ক পরিবেশে অ্যামিনো অ্যাসিডের পলিমারাইজেশন দ্বারা উৎপন্ন প্রোটিনের মতো জৈব অণুকে প্রোটিনয়েড বলে। আদিকোশ গঠনে প্রোটিনয়েডের ভূমিকা ছিল বলে মনে করা হয়।
ডারউইন প্রজাতির জীবনসংগ্রামকে তিনভাগে ভাগ করেছেন — 1. অন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম (নিজ প্রজাতিভুক্ত জীবের মধ্যে প্রতিযোগিতা), 2. আন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম (ভিন্ন প্রজাতিভুক্ত জীবের মধ্যে প্রতিযোগিতা) এবং 3. প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম।
পাখি ও আরশোলার ডানা হল সমবৃত্তীয় অঙ্গের উদাহরণ। এই দুটি প্রাণীর ডানার কাজ একই ধরনের হলেও এদের উৎপত্তি ও অন্তর্গঠন সম্পূর্ণ পৃথক।
জীববিদ্যার যে শাখায় জীবাশ্ম নমুনা নিরীক্ষণ করে জীবের অতীত ও অভিব্যক্তি সম্বন্ধে ধারণা করা হয়, তাকে প্রত্নজীববিদ্যা বা প্যালিওন্টলজি বলে।
জার্মান বিজ্ঞানী আর্নস্ট হেকেল ভ্রূণতত্ত্ব দ্বারা অভিব্যক্তি ব্যাখ্যার মাধ্যমে ডারউইনের বক্তব্যকে আরও সম্প্রসারিত করেন। তিনি আটটি প্রাণীর 3টি ভ্রুণ পর্যায়ের (মোট 24টি) চিত্র প্রকাশ করে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে জীবজনি জাতিজনির পুনরাবৃত্তি করে (Ontogeny repeats phylogeny)। অর্থাৎ, কোনো প্রাণীর ভ্রূণপর্যায়গুলি প্রকৃতপক্ষে ওই প্রাণীটির অভিব্যক্তির ক্রমপর্যায়গুলিকে সূচিত করে। পরবর্তীকালে দেখা যায় যে এই চিত্রগুলি অতিরঞ্জিত ছিল ও বর্তমানে তত্ত্বটি ভুল বলে প্রমাণিত হয়েছে।
চার্লস ডারউইন 1859 খ্রিস্টাব্দে তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘অন দি অরিজিন অফ স্পিসিস বাই মিস্ অফ ন্যাচারাল সিলেকশন’ (On the origin of Species by means of Natural Selection)-এ বিবর্তন সম্পর্কিত অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক নির্বাচন মতবাদ আলোচনা করেন। এই মতবাদের জন্যই চার্লস ডারউইন বিখ্যাত।
জীব তার অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। সীমিত খাদ্য ও বাসস্থানের কারণে তাদের প্রতিনিয়ত প্রতিযোগিতা চালিয়ে যেতে হয় এবং এর ফলে সৃষ্ট সংগ্রামকে জীবনসংগ্রাম বলা হয়।
উপযুক্ত আহার, বাসস্থান এবং প্রজননের জন্য একই প্রজাতির বিভিন্ন সদস্যের মধ্যে যে সংগ্রাম চলে তাকে অন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম বলে। যেমন — খাদ্যের জন্য একাধিক কুকুরের মধ্যে লড়াই, মানুষের মধ্যে যুদ্ধ প্রভৃতি।
উপযুক্ত আহার ও বাসস্থানের জন্য অর্থাৎ নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য দুই বা ততোধিক প্রজাতির সদস্যদের মধ্যে যে সংগ্রাম চলে তাকে আন্তঃপ্রজাতি সংগ্রাম বলে। যেমন — বিড়াল-ইঁদুর, সাপ-বেজি, মানুষ-পরজীবীর লড়াই।
উভচরের হৃৎপিণ্ডে দুটি অলিন্দ ও একটি নিলয় থাকায় বিশুদ্ধ রক্ত ও দূষিত রক্তের সামান্য মিশ্রণ ঘটে। কিন্তু স্তন্যপায়ীদের হূৎপিণ্ডে দুষিত ও বিশুদ্ধ রক্ত কোনোভাবে মেশে না, কারণ এদের দুটি অলিন্দ ও দুটি নিলয় থাকে। তবে উভয় গোষ্ঠীর হূৎপিণ্ডের মৌলিক গঠন থেকে প্রমাণিত হয় যে প্রাণীর গঠন সরল থেকে ধীরে ধীরে জটিল হয়েছে, যা বিবর্তনকে বিজ্ঞানসম্মতভাবে সমর্থন করে।
যে বৈশিষ্ট্যের জন্য একটি জীব অন্য জীবের থেকে আলাদারূপে প্রতিপন্ন হয় তাকে ভেদ বা প্রকরণ বা ভ্যারিয়েশান (variation) বলা হয়। যেমন — বিভিন্ন ফিঞ্চ পাখির ঠোঁটের আকার ও আকৃতি বিভিন্ন প্রকার হয়। কুকুরছানার গাত্রবর্ণ ও তার দেহাকৃতি বিভিন্ন রকম হয় প্রভৃতি।
বিজ্ঞানী ওয়াইসম্যানের মতে, জীবের বংশগত বৈশিষ্ট্যগুলি দেহকোশের মাধ্যমে পরবর্তী বংশে সঞ্চারিত হয় না, বরং এই বৈশিষ্ট্যগুলি জননকোশের মাধ্যমে পুরুষানুক্রমে সঞ্চারিত হয়। এটিই জার্মপ্লাজমবাদ নামে পরিচিত।
মিউটেশন – ক্রোমোজোমে উপস্থিত কোনো জিনের গঠনের আকস্মিক ও স্থায়ী পরিবর্তনকে মিউটেশন বা পরিব্যক্তি বলে।
প্রবক্তা – মিউটেশন তত্ত্বের প্রবক্তা হলেন হুগো দ্য ভ্রিস।
সম্পর্কবিহীন জীবসমূহের সমবৃত্তীয় অঙ্গের একই পরিবেশে বসবাস করার ফলে একই ধরনের অভিযোজন ঘটে, এই ধরনের অভিব্যক্তিজনিত অভিযোজনকে অভিসারী অভিযোজন এবং ওই ধরনের বিবর্তনকে অভিসারী অভিব্যক্তি বলে। উদাহরণ — মটর গাছের আকর্ষ (রূপান্তরিত পত্রক) ও কুমড়ো গাছের আকর্ষ (রূপান্তরিত শাখা)।
একই উদ্ংশীয় জীব থেকে উৎপন্ন দুটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক- যুক্ত প্রাণীগোষ্ঠী একই পরিবেশে অভিযোজিত হওয়ার কারণে সদৃশ বৈশিষ্ট্য অর্জন করলে এই ধরনের অভিব্যক্তিজনিত অভিযোজনকে সমান্তরাল অভিযোজন এবং ওই প্রকার অভিব্যক্তিতে সমান্তরাল অভিব্যক্তি বলে। উদাহরণ — অ্যান্টিলোপ ও হরিণদের দ্রুত দৌড়োনোর জন্য দ্বিখণ্ডিত ক্ষুরের উদ্ভব।
বিভিন্ন পরিবেশে অভিযোজনের জন্য উৎপত্তি ও গঠনগতভাবে একই অঙ্গের কার্যকারিতা ও আকার বিভিন্ন হয়। এইপ্রকার অভিযোজনকে অপসারী অভিযোজন বলে। এর ফলে জীবদেহে বিভিন্ন অঙ্গের যে বিবর্তন ঘটে, তাকে অপসারী বিবর্তন বা অভিব্যক্তি বলে। উদাহরণ — ঘোড়ার অগ্রপদ, মানুষের হাত, তিমির ফ্লিপার উৎপত্তি ও অন্তর্গঠনগত দিক থেকে এক হলেও বহিরাকৃতি ও কার্যগত দিক থেকে আলাদা।
1828 খ্রিস্টাব্দে জার্মান বিজ্ঞানী ভন বেয়ার ভ্রূণতত্ত্বের নীতি প্রনয়ণ করেন। এটি অনুযায়ী 1. বিভিন্ন জীবের প্রজাতিতে সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলি প্রথমে ভ্রূণে আবির্ভূত হয়, 2. ভ্রূণের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভিন্ন প্রজাতিতে ভিন্ন ভিন্ন বিশেষ বৈশিষ্ট্যের আগমন ঘটে।
বিবর্তনের ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে দুটি পৃথক জীবগোষ্ঠীর মধ্যে সংযোগকারী বহু প্রাণী লুপ্ত হওয়ায় সেই স্থানে ফাঁক সৃষ্টি হয়েছে। এই ধরনের প্রাণীদের মিসিং লিংক বা হৃতযোজক বলা হয়। জীবাশ্ম আবিষ্কারের মাধ্যমে এই ফাঁকগুলি পূরণ করা সম্ভব হয়েছে। এইরূপ একটি প্রাণী হল আর্কিওপটেরিক্স। এদের মধ্যে সরীসৃপ ও পক্ষী-উভয় শ্রেণির বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। এই কারণে এদের এই দুটি শ্রেণির মিসিং লিংক হিসেবে গণ্য করা হয়।
প্রাণীর ক্রমবিকাশের বেশ কিছু প্রমাণ জীবাশ্ম থেকে পাওয়া যায়। জীবাশ্ম থেকে প্রধানত যে সকল তথ্য জনা যায় সেগুলি এখানে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।
1. জীবাশ্ম পরীক্ষা করে পৃথিবীতে ওই জীবের বসবাসের সময়কাল, দৈহিক গঠন, অতীতের পরিবেশ সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। 2. বর্তমান জীবের প্রাচীন প্রকৃতি কী ছিল সেই সম্বন্ধে জানা যায়। যেমন — হাতি বা ঘোড়ার জীবাশ্ম থেকে বোঝা যায় যে তাদের আদি পুরুষের প্রকৃতি কীরূপ ছিল এবং কীভাবে তার পরিবর্তন ঘটেছে। 3. ভূ-পৃষ্ঠের গভীরে প্রাপ্ত সরলতর জীবের জীবাশ্ম থেকে বোঝা যায় যে সুদূর অতীতে সরল জীব থেকেই ক্রমশ জটিল জীবের আবির্ভাব ঘটেছে।
ভন বেয়ারের ভ্রুণতত্ত্বের নীতির ওপর নির্ভর করে বিজ্ঞানী চার্লস ডারউইন ভ্রুণতত্ত্বকে অভিব্যক্তির ব্যাখ্যায় প্রথম ব্যবহার করেন। তিনি বলেন যে বিভিন্ন প্রাণীর ভূণগত মিল তাদের একই পূর্বপুরুষ থেকে উৎপত্তি সূচিত করে। তিনি আরও বলেন যে, ভ্রুণে যে বিশেষ বৈশিষ্ট্য দেখা যায় তা প্রকৃতপক্ষে প্রাণীটিকে পরিবেশে অভিযোজিত হতে সাহায্য করে।
মুখছিদ্রের ঠিক পরে অবস্থিত খাদ্যনালীর অংশকে গলবিল বলে। কর্ডাটা পর্বের সমস্ত প্রাণীতে জীবনচক্রের কোনো না কোনো দশায় গলবিলে এই কয়েকটি খাঁজ গঠিত হয়। এই খাঁজগুলি থেকে পরবর্তীকালে মাছদের ক্ষেত্রে ফুলকা গঠিত হয়। অন্যান্য মেরুদণ্ডীদের ক্ষেত্রে এর থেকে অন্যান্য গঠন তৈরি হয়। এই অংশকে গলবিলীয় ফুলকা খাঁজ বলে।
আধুনিক বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ডারউইনের তত্ত্বের মধ্যে কিছু ত্রুটি লক্ষ করা যায়। সেই কারণে ওই তত্ত্বকে সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ না করে বিভিন্ন পরিবর্ধন এবং পরিবর্তন সাধন করা হয়েছে। ওই পরিবর্তনগুলির সমন্বয়সাধনের মাধ্যমে যে তত্ত্বের সৃষ্টি হয়েছে, তাকে সংশ্লেষ মতবাদ বলা হয়।
বিবর্তনের সংশ্লেষ মতবাদটি যে চারটি পদ্ধতির ভিত্তিতে গঠিত, সেগুলি হল — 1. জিন মিউটেশন, 2. ক্রোমোজোমের সংখ্যা ও আকৃতির পরিবর্তন, 3. জিনগত পুনঃসংযুক্তি এবং 4. প্রাকৃতিক নির্বাচন।
ল্যামার্কের অর্জিত বৈশিষ্ট্যের বংশানুসরণ মতবাদটির পরিবেশ-জীব আন্তঃক্রিয়ার আলোতে আধুনিক ব্যাখ্যাকে নয়া ল্যামার্কবাদ বা নিওল্যামার্কিজম বলে। বিজ্ঞানী ওয়াডিংটন, প্যাকার্ড, স্পেনসার প্রমুখ বিজ্ঞানীরা হলেন নয়া-ল্যামার্কবাদী।
পরিব্যক্তি তত্ত্ব ও মেন্ডেলীয় জেনেটিক্স দ্বারা ডারউইনের মতবাদটির আধুনিক ব্যাখ্যাকে বলা হয় নয়া ডারউইনবাদ বা নিওডারউইনিজম। মরগ্যান, ডবঝানস্কি হলডেন প্রভৃতি বিজ্ঞানীরা এই মতবাদ প্রনয়ণ করেন।
আদি পৃথিবীতে জীবের রাসায়নিক উৎপত্তির দ্বিতীয় পর্যায়ে সরল জৈব যৌগ থেকে বিভিন্ন বিক্রিয়ার দ্বারা জটিল জৈব যৌগ, যেমন অ্যামিনো অ্যাসিড, নিউক্লিওটাইড, ফ্যাট ইত্যাদি তৈরি হয়। এই যৌগগুলি সমুদ্রের জলে মিশে যে উত্তপ্ত তরল পদার্থ গঠন করে, তাকে হট ডাইলিউট স্যুপ বা তপ্ত লঘু স্যুপ বলা হয়। এর থেকে আদি কোশ সৃষ্টি হয় বলে একে প্রিবায়োটিক স্যুপও বলা হয়।
রাসায়নিক স্বভোজী জীব পরবর্তীকালে ক্রমান্বয়ে সালোকসংশ্লেষকারী স্বভোজী জীবের উৎপত্তি ঘটায়। এদের মাধ্যমেই বায়ুমণ্ডলে প্রথম মুক্ত অক্সিজেনের আবির্ভাব ঘটে।
রাশিয়ান বিজ্ঞানী এরিক ফন দানিকেন মনে করেন যে অন্য কোনো গ্রহ থেকে পৃথিবীতে জীবের সর্বপ্রথম আবির্ভাব হয়। এই ধারণাকে জীব উৎপত্তির ভিনগ্রহ উদ্ভব তত্ত্ব বলা হয়।
জীবন সৃষ্টির প্রাক্কালে জৈব উপাদানপূর্ণ লিপিড দ্বিস্তর আবৃত যে গঠন থেকে প্রোক্যারিওটিক কোশের উদ্ভব হয়েছিল তাকে প্রোটোবায়োন্ট বলে। যেমন — মাইক্রোস্ফিয়ার।
জার্মান বিজ্ঞানী ফ্লুজার-এর মতে পৃথিবীর শীতলীকরণের সময় কার্বন ও নাইট্রোজেন মিলিত হয়ে সায়ানোজেন নামক প্রোটিন যৌগ উৎপন্ন করে। সায়ানোজেন থেকে প্রোটোপ্লাজমের উৎপত্তি ঘটে। এই ধারণাকে সায়ানোজেন মতবাদ বলে।
গ্রীক দার্শনিক অ্যারিস্টট্ল, ভন হেলমন্ট প্রভৃতি ব্যক্তি এই মতবাদের প্রবক্তা। তাঁদের মতে অজৈব উপাদান থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পৃথিবীতে জীবের উৎপত্তি ঘটেছিল। অ্যাবায়োজেনেসিসের অপর নাম বায়োপোয়েসিস।
ব্যক্তিজনি জীবজনির সংক্ষিপ্ত পুনরাবৃত্তি করে (Ontogeny repeats Phylogeny) — এটিই বায়োজেনেটিক সূত্র। অর্থাৎ প্রতিটি জীবের ভ্রূণ পর্যায়গুলি (জীবগুলি) ওই জীবটির অভিব্যক্তি পর্যায়গুলির (জাতিগুলি) মতো হয়। বর্তমানে প্রমাণিত যে তাঁর প্রণীত সূত্রটি সঠিক নয় এবং তা প্রমাণের জন্য তিনি যে চিত্রগুলি উপস্থাপিত করেছিলেন তা অতিরঞ্জিত ছিল।
উভয়ের গঠনে হিউমেরাস, রেডিও-আলনা, ফ্যালানজেস, কারপাল ও মেটাকারপাল হাড় এবং পেশি ও স্নায়ুবিন্যাসের সাদৃশ্য দেখে উভয়কে সমসংস্থ অঙ্গ বলে চেনা যায়।
©kamaleshforeducation.in(2023)